অতি ভারী বৃষ্টিতে পাহাড়ি অঞ্চলে ঘন ঘন ধস নেমে জনজীবন স্তব্ধ হয়ে পড়া এবং নদীর জলস্ফীতিজনিত কারণে ও বাঁধ থেকে বিপুল জল ছাড়ার ফলে বিস্তীর্ণ অঞ্চল, চাষের জমি তলিয়ে যাওয়া— এমনটা গত কয়েক বছরে ভারতে স্বাভাবিকতায় পরিণত। সম্প্রতি দিনকয়েকের তুমুল বৃষ্টিজনিত বন্যা এবং ভূমিধসের আক্রমণে যেমন বিপর্যস্ত ত্রিপুরা। ঘরছাড়া লক্ষাধিক মানুষ, মৃত অন্তত ২৬। এবং, এই পর্বে বাংলাদেশের এক বিশাল অঞ্চলও বন্যাকবলিত। সে দেশের প্রশাসনিক স্তরে অভিযোগ উঠেছে, ত্রিপুরায় গোমতী নদীর বাঁধে স্লুস গেট খুলে দেওয়াতেই বাংলাদেশে এমন ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি। যদিও ভারতের বিবৃতি জানাচ্ছে যে, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত গোমতী নদীর অববাহিকা অঞ্চলে প্রবল বৃষ্টিপাত হয়েছে। বাংলাদেশের অবস্থান নিম্ন অববাহিকা অঞ্চলে হওয়ায় জলের প্রবাহ বন্যা পরিস্থিতিকে জটিল করেছে। যে ডুম্বুর বাঁধকে এই বন্যার জন্য দায়ী করা হচ্ছে, মূলত বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্যই সেই বাঁধটি ব্যবহৃত হয়, যে বিদ্যুতের কিয়দংশ বাংলাদেশেও যায়। প্রবল বৃষ্টিতে জলাধার উপচে যাওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ায় কিছু জল ছাড়া হয়েছে মাত্র, যা বাংলাদেশের বন্যার কারণ নয়।
বর্ষার মরসুমে ভারতের মতো দেশে বন্যা, ভূমিধস স্বাভাবিক ঘটনা। অ-স্বাভাবিক হল পাহাড় ও সংলগ্ন অঞ্চলে বৃষ্টির চরিত্র বদল এবং বন্যার তীব্রতা বৃদ্ধি। উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম— সর্বত্রই একই চিত্র। অথচ, বন্যা এবং খরা— এই যুগপৎ আক্রমণ প্রতিহত করতে ভারত বিভিন্ন নীতি এবং প্রকল্পের সূচনা করেছে যা এক দিকে জলসুরক্ষার ব্যবস্থা করবে, অন্য দিকে পরিবর্তিত জলবায়ুর সঙ্গে যুঝতে সক্ষম হবে। এর মধ্যে আগাম বন্যা সতর্কতা ব্যবস্থা, বাঁধগুলির নিরাপত্তা বৃদ্ধি, বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য জাতীয় পরিকল্পনা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। কিন্তু এগুলি যে ক্রমবর্ধমান বিপর্যয়ের সংখ্যা এবং তীব্রতার নিরিখে যৎসামান্য, তা দেশের বিভিন্ন প্রান্তের দুর্যোগ-চিত্র প্রতিনিয়ত বুঝিয়ে দেয়। সর্বোপরি, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অপরিকল্পিত, বিবেচনাহীন উন্নয়ন প্রকল্প, যা বন্যার তীব্রতাকে বহু গুণ বৃদ্ধি করছে। অতিবৃষ্টি বন্যার একমাত্র কারণ নয়। নদীর গা ঘেঁষে গড়ে ওঠা অবৈধ নির্মাণ, উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলে একের পর এক বাঁধ দিয়ে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ আটকে রাখা, বাঁধের পিছনে জমতে থাকা পলি, বালির কারণে ক্রমশ ভরাট হয়ে আসা নদীখাত, নদীখাত মুক্ত রাখতে নিয়মিত ড্রেজ়িং না করা— এই কারণগুলিও সমান ভাবে দায়ী। সাম্প্রতিক ত্রিপুরার বিপর্যয়কেও সেই আধারেই দেখা প্রয়োজন।
সম্প্রতি কেরলের ওয়েনাড়ে ভয়ঙ্কর বন্যা ও ধস দেখিয়েছিল, এ দেশে দুর্যোগের পূর্বাভাস সংক্রান্ত দফতরগুলির মধ্যে সমন্বয়ের অভাব যথেষ্ট। গুরুতর ত্রুটি রয়েছে বাঁধ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও। ২০১৮ সালে কেরলে প্রবল বন্যার পরে প্রশ্ন উঠেছিল, অতিবৃষ্টির পূর্বাভাস পেয়ে জলাধারগুলিকে আগাম খালি করে রাখা হলে কি বন্যার ক্ষয়ক্ষতি হ্রাস করা যেত না? সেই প্রশ্ন সাম্প্রতিক বন্যা ও ধসের পরিপ্রেক্ষিতেও একাধিক বার উঠেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ মাথায় নিয়ে শুধুমাত্র প্রকল্পের ঘোষণা আর অর্থ বরাদ্দে আটকে থাকা কাণ্ডজ্ঞানের পরিচয় নয়। তার জন্য সর্বস্তরে এক নিখুঁত পরিকল্পনা প্রয়োজন। সে বিষয়ে প্রস্তুতির অভাব প্রকট।