ভারতে নারী সুরক্ষা এবং ক্ষমতায়নের অভীষ্ট লক্ষ্য কি ষোলো আনাই পূরণ হইয়াছে? আগামী দিনে ইহার জন্য তবে কেন্দ্রীয় বরাদ্দের আর কোনও প্রয়োজন নাই? নির্ভয়া তহবিল লইয়া স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা অক্সফ্যাম-এর সাম্প্রতিক রিপোর্ট দেখিয়া এহেন প্রশ্ন উঠা আশ্চর্য নহে। রিপোর্ট বলিতেছে, ২০১৯-২০ অর্থবর্ষের বাজেটে কেন্দ্র নির্ভয়া তহবিলের জন্য বরাদ্দ করিয়াছিল ৪৩৫৭.৬২ কোটি টাকা। কিন্তু সরাসরি নারীকল্যাণে তাহা বিশেষ কাজে লাগে নাই। বরাদ্দের সিংহভাগ পাইয়াছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। ফরেন্সিক ল্যাব, সাইবার অপরাধ মোকাবিলার পরিকাঠামো উন্নত করা হইয়াছে, এমনকি বিপর্যয় মোকাবিলার কাজেও এই অর্থ ব্যবহৃত হইয়াছে। এবং সংখ্যাবৃদ্ধি হইয়াছে সিসিটিভি, জোরালো পথবাতির। অর্থাৎ, যে দেশে নারী-নির্যাতনের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান, সেই দেশে নির্বাচিত সরকার নারী সুরক্ষা বলিতে মোটের উপর এতটুকুই বুঝে।
অথচ, নারী সুরক্ষার বিষয়টি যে এই নামমাত্র ব্যবস্থার উপর নির্ভর করে না, ২০১২ সালের ডিসেম্বরে দিল্লির সেই রাত বারংবার তাহা মনে করাইয়া দেয়। সেই সময় গণদাবি উঠিয়াছিল, প্রচলিত আইনে পরিবর্তন আনিবার। অতঃপর ধর্ষণ সংক্রান্ত আইন হইতে নির্যাতিতার মেডিক্যাল পরীক্ষা, তাঁহার কাউন্সেলিং-এর নির্দেশিকা— উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের আশ্বাস মিলিয়াছিল। পরের বৎসরই নির্ভয়া তহবিল গঠনের কথা ঘোষিত হয়। তাই শুধুমাত্র নারী সুরক্ষাই নহে, এক অচলায়তনকে ধাক্কা দিয়া বহুকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনেরও ইঙ্গিত দিয়াছিল এই তহবিল। সেই ইতিহাস তুচ্ছ করিবার নহে। নারীকল্যাণে দায়বদ্ধ সরকার সেই ইতিহাসকে মর্যাদা দিয়া যথাযথ ভাবে তহবিলের টাকা খরচ করিবে, যথেষ্ট অর্থ বরাদ্দ করিবে, ইহাই প্রত্যাশিত ছিল।
আশ্চর্য ইহাই, ক্ষমতায় আসিবার পূর্বে বিজেপির অন্যতম প্রচার-অস্ত্র ছিল— বেটি বচাও, বেটি পড়াও। ইহা যে কতখানি অন্তঃসারশূন্য, নির্বাচনী চমকমাত্র, নির্ভয়া তহবিলই তাহার জ্বলন্ত প্রমাণ। এক দিকে ধর্ষণ, যৌন হেনস্থার সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাইতেছে, অন্য দিকে, চূড়ান্ত অবহেলিত হইতেছে নির্ভয়া তহবিল। রিপোর্ট বলিতেছে, ক্ষতিগ্রস্তদের ৬০ শতাংশকে সাহায্য করিতে হইলে যে টাকা প্রয়োজন, তাহার ২৫ শতাংশও বরাদ্দ হয় নাই। ফলত, তহবিল থাকিলেও আশ্রয় শিবিরগুলিতে প্রশিক্ষিত কর্মী নিয়োগ করা যায় না, ধর্ষণের প্রমাণ সংরক্ষিত রাখিবার পর্যাপ্ত পরিকাঠামো নির্মিত হয় না, এমনকি নির্যাতিতাকে উদ্ধারের পর তাঁহাকে নূতন পোশাকও দেওয়া যায় না। এবং অভিযোগ, তহবিলে যেটুকু অর্থ সঞ্চিত আছে, তাহাও যথাযথ ব্যবহার করা হয় না। আধিকারিকদেরও স্পষ্ট ধারণা নাই, এই খাতের অর্থ কোথায়, কী ভাবে ব্যয় করা হইতেছে। ইহা অপেক্ষা লজ্জার আর কী হইতে পারে! অক্সফ্যামের রিপোর্ট বলিতেছে, তহবিলের অর্থে অমিত শাহের দফতর পুলিশের হাত শক্ত করিতেছে। পুলিশের জন্য অর্থ প্রয়োজন, তাহাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু, নারী নিরাপত্তার জন্য নির্দিষ্ট টাকায় সেই কাজ করিলে তহবিল গঠনের মূল উদ্দেশ্যটিই বিনষ্ট হয়। কেহ সন্দেহ প্রকাশ করিতে পারেন যে, নারীর নিরাপত্তা ইত্যাদি নির্বাচনী বিষয় হিসাবে যতখানি আকর্ষক, নেতাদের নিকট আসলে তাহার ততখানি গুরুত্ব নাই। ফলে, তহবিল থাকিলেও তাহার ব্যবহার হইয়া উঠে না।