বাংলা ভাষার গতি ও প্রকৃতিতে বহুত্ববাদী ঐতিহ্যের দাবি অনস্বীকার্য। ফাইল ছবি।
জল বনাম পানি। মা বনাম আম্মা। অতিথিসেবা বনাম দাওয়াত— আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে এ বার সহসা জোর তর্কের হাওয়া উঠেছিল। সেই বিতর্কে বিস্তর ভেজাল মিশেছে, নির্বোধ আধিপত্যের আস্ফালন এবং পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান রীতি অনুসারী কুরুচিকর তরজাও বাদ থাকেনি। কিন্তু তার পাশাপাশি শোনা গিয়েছে সহিষ্ণুতার স্বরও। বিশেষত, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন: বাংলা ভাষায় ‘বনাম’-এর কোনও স্থান নেই, যে যে ভাবে বলতে চান বলবেন। দলীয় রাজনীতি ও সরকারি শাসনযন্ত্রের স্ব-ভাবেও এমন সুবিবেচক উদারতা কেন যথেষ্ট দেখা যায় না, সেই প্রশ্ন অসঙ্গত নয়, তবে তা অন্য প্রসঙ্গ। আপাতত ভাষার ভুবনে ‘দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে’-র অঙ্গীকারটুকু একুশে ফেব্রুয়ারিতে বঙ্গবাসীর প্রাপ্তি বইকি। বাংলা ভাষার গতি ও প্রকৃতিতে বহুত্ববাদী ঐতিহ্যের দাবি অনস্বীকার্য। আপন পরিসরে অন্য বিভিন্ন ভাষার শব্দকে গ্রহণ করে এবং বঙ্গভাষী নানা অঞ্চল তথা বর্গের শব্দান্তরকে ধারণ করে এগিয়ে চলার প্রবণতাই বাংলা ভাষার স্ব-ভাব।
কিন্তু গ্রহণশীলতা যেন চিন্তাহীন বিবেচনাহীন যথেচ্ছাচারের নামান্তর হয়ে না দাঁড়ায়। প্রত্যেক ভাষার নিজস্ব একটি কাঠামো থাকে। স্বধর্মে সুস্থিত থেকেই সে ক্রমাগত ভিন্ন ভাষার শব্দকে গ্রহণ করে, আঞ্চলিক বা অন্য ধরনের নানা বৈচিত্রকে স্থান করে দেয়। এই স্বাঙ্গীকরণের প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ, অনুশীলন-নির্ভর— লোকসমাজের সুষ্ঠু চর্চা ও প্রয়োগের মধ্য দিয়েই তা কার্যকর হয়। তার পরিবর্তে, নিছক চলতি হাওয়ার পন্থী হওয়ার নেশায়, অহেতুক এবং নির্বিচারে অন্য ভাষার শব্দ ও শৈলীকে আত্মসাৎ করলে ভাষার সমৃদ্ধি হয় না, দূষণ ঘটে। অধুনা বাংলা ভাষায় ইংরেজি এবং হিন্দি শব্দের অবিরত প্রবেশ ঘটছে, শৈলীতেও এই দু’টি ভাষার প্রভাব উত্তরোত্তর প্রকট হচ্ছে। কেবল মুখের কথায় নয়, লেখাতেও অনেক সময়েই সেই মিশ্রণ এমন মাত্রায় পৌঁছে যাচ্ছে যে, তাকে বাংলা ভাষা বলে চিনতে সমস্যা হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতেই ভাষার স্বাস্থ্যের প্রতি মনোযোগী হওয়া দরকার, তার বিকৃতি সম্পর্কে সতর্ক থাকা দরকার। এখানেই ‘প্রমিত’ বাংলার গুরুত্ব। প্রমিত মানে কোনও কৃত্রিম, সূত্রবদ্ধ, কষ্টসৃষ্ট ভাষা নয়, প্রমিত ভাষার প্রথম এবং প্রধান চরিত্রলক্ষণ তার সৌষ্ঠব। উদারতার নামে যেন ভাষার সেই সুষ্ঠু পরিমিতিকে বিসর্জন দেওয়া না হয়।
কাজটি কঠিন। ভাষাকে একই সঙ্গে গতিশীল এবং সুপথগামী রাখবার কোনও দেশকালনিরপেক্ষ সূত্র নেই। কিন্তু সমকালীন বাস্তবের পরিপ্রেক্ষিতে একটি কথা মনে রাখা দরকার। বাংলা ভাষার ভান্ডারে বিশেষত উনিশ শতকের মধ্যপর্ব থেকে যে বহুবর্ণ ঐশ্বর্য সঞ্চিত হয়েছে, আজও লোকসমাজের এক বিরাট অংশের কাছে তার প্রায় কিছুই পৌঁছে দেওয়া যায়নি। নাগরিক উচ্চবর্গের সঙ্গে বৃহত্তর সমাজের ইতিহাস-লালিত দূরত্ব তার একটি বড় কারণ। সেই দূরত্ব প্রবল উদ্যমে দূর করা আবশ্যক। এবং সেই জরুরি কাজটি এখনও তেমন ভাবে করাই যায়নি। কেবল সাহিত্য নয়, বাংলা ভাষায় বিভিন্ন বিদ্যা চর্চার সমৃদ্ধ সৃষ্টির সঙ্গে বহু জনের পরিচয় ঘটানোর মধ্য দিয়ে এক যথার্থ সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়োজন আছে, সুযোগও আছে। সেই সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে সমাজে ভাষার ভিতটি সুদৃঢ় হবে, আবার সেই দৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে বঙ্গভাষীরা স্বাভাবিক স্বাচ্ছন্দ্যে বিভিন্ন শব্দমালা ও বাচনভঙ্গির সমন্বয় ঘটাতে পারবেন। অন্য ভাষা তথা সংস্কৃতির দাপটের কাছে দুর্বল এবং অলস আত্মসমর্পণ নয়, সেই প্রক্রিয়া হয়ে উঠবে বহুত্বের উদার আত্তীকরণ। তার জন্য আবশ্যক, সঙ্কীর্ণ অভিমান নয়, সক্ষম ও সমর্থ প্রত্যয়।