Dr. BR Ambedkar

ব্রাহ্মণ্যবাদ এবং আম্বেডকর

আম্বেডকর বলেছিলেন, এটি অত্যন্ত বেদনার যে আজও এ দেশে হিন্দু জাতিভেদ প্রথা অব্যাহত। সমর্থকরা বলেন, জাতি বিভাজন আসলে শ্রম বিভাজন। শ্রম বিভাজন উন্নয়নশীল সমাজেরই বিশেষত্ব, তাই জাতিভেদে কোনও অগৌরব নেই।

Advertisement

অরবিন্দ সামন্ত

শেষ আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০২৫ ০৫:২৯
Share:

এখন থেকে প্রায় নব্বই বছর আগে ভীমরাও রামজি আম্বেডকর জাতিভেদ প্রথার বিনাশ চেয়ে একটি অসাধারণ বক্তৃতার খসড়া রচনা করেছিলেন। কিন্তু সেই আমন্ত্রিত বক্তৃতা তাঁর দেওয়া হয়ে ওঠেনি, কেননা তিনি বর্ণাশ্রমের মূল কাঠামোকেই প্রশ্ন করেন, মনুবাদকে সমূল উচ্ছেদের প্রস্তাব করেন। উদ্যোক্তারা মনে করেছিলেন এমন চরমপন্থী বক্তব্য হিন্দুদের সহ্য হবে না। বর্ণাশ্রমের রক্ষণশীলতা সমকালে গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ উভয়েই মেনে নিয়েছিলেন। দু’জনেই ছিলেন সমাজমনের বিবর্তনমূলক বদলে বিশ্বাসী। আম্বেডকর এমনতর স্বপ্নবিলাসী ছিলেন না। তিনি জাতিভেদ পুরোপুরি উচ্ছেদের পক্ষে রায় দিয়েছিলেন। আজ যখন ব্রাহ্মণ্যবাদের পিঠে সওয়ার হয়েছে হিন্দুত্বের আগ্রাসন, তখন ভেবে দেখা দরকার, সে দিন জাতিভেদ আর অস্পৃশ্যতা নিয়ে ঠিক কী ভেবেছিলেন, কী লিখেছিলেন আম্বেডকর?

Advertisement

আম্বেডকর বলেছিলেন, এটি অত্যন্ত বেদনার যে আজও এ দেশে হিন্দু জাতিভেদ প্রথা অব্যাহত। সমর্থকরা বলেন, জাতি বিভাজন আসলে শ্রম বিভাজন। শ্রম বিভাজন উন্নয়নশীল সমাজেরই বিশেষত্ব, তাই জাতিভেদে কোনও অগৌরব নেই। বরং তা সমাজ উন্নয়নের অন্যতম হাতিয়ার। আম্বেডকর উত্তরে বললেন, আসলে এ দেশে জাতিভেদ শ্রম-বিভাজন নয়, শ্রমিকেরই জল-অচল বিভাজন। শ্রমিককে সামাজিক সম্মানের ক্রমে বিভক্ত করা হয়েছে। ব্যক্তির ইচ্ছা আর দক্ষতাকে গুরুত্বহীন করে দিয়ে তাকে জন্মগত সামাজিক অবস্থানের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। তিনি বললেন, মানুষের উদ্যম সদা পরিবর্তনশীল। তাই এক পেশা থেকে পছন্দের অন্য পেশায় সে উত্তীর্ণ হতে চায়। কিন্তু জাতিভেদ সেই সুযোগ রাখেনি। যে-পেশায় কাজের সুযোগ বা চাহিদা বেশি, সে-পেশায় যোগদানের প্রধান বাধা হল জাতিভেদ। আবার যার যে-কাজে উৎসাহ নেই, তাকে সে-কাজেই সারা জীবন পড়ে থাকতে হয় বলে কাজের গুণগত মানও হ্রাস পেতে থাকে। কাজে ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা বাড়ে। আরও বড় কথা, বর্ণহিন্দুরা কিছু কাজকে অবজ্ঞা এবং ঘৃণার চোখে দেখে, সেই কাজগুলি অস্পৃশ্য জাতির জন্যই বরাদ্দ করে। অথচ যে-কাজে দক্ষতা নেই, আনন্দ নেই, ক্রমোন্নতির সম্ভাবনা নেই, তাতে এক জনকে সারা জীবন জুতে রাখা কোনও কল্যাণকর রাষ্ট্রের লক্ষ্য হতে পারে না।

অনেক সময় বায়োলজিক্যাল কারণ দেখিয়ে জাতিভেদকে একটি অপরিহার্য সামাজিক ব্যবস্থা বলে সাব্যস্ত করা হয়। বলা হয়, জাতিভেদ জরুরি, কেননা এর মাধ্যমে ‘রেস’ বা জাতির রক্তের শুদ্ধতা রক্ষা করা হয়। আম্বেডকর বলছেন, এথনোলজিস্টরা বলেন, বিশ্বে বিশুদ্ধ, অবিমিশ্র জাতি বলে কিছু নেই। এ দেশেও এমন শ্রেণি বা জাতি নেই যা বৈদেশিক রক্তের সংমিশ্রণমুক্ত। বস্তুত এ দেশে জাতিপ্রথার উদ্ভব হয়েছে মানুষের মধ্যে রক্ত ও সংস্কৃতির সংমিশ্রণের অনেক পরে। তিনি প্রশ্ন করেছেন, পঞ্জাবের এক জন ব্রাহ্মণের সঙ্গে মাদ্রাজি ব্রাহ্মণের জাতিগত সাদৃশ্যটি কী? কিংবা বাংলার অস্পৃশ্যর সঙ্গে মাদ্রাজের অস্পৃশ্যের? জাতিভেদ প্রথা জাতির সীমানা নির্ধারণ করে না, তা মানুষে মানুষে সামাজিক বিভেদের পাঁচিল তুলে দেয় মাত্র।

Advertisement

আম্বেডকর বললেন, জাতপাত জাতির কোনও আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ঘটাতে পারেনি। বরং জাতিভেদ ও অস্পৃশ্যতা হিন্দুদের পুরোপুরি বিশৃঙ্খল ও নীতিভ্রষ্ট করে দিয়েছে। সর্বাগ্রে স্বীকার করা প্রয়োজন, ‘হিন্দু সমাজ’ কথাটিই একটি মিথ। ‘হিন্দু’ অভিধাটি বিদেশিদের দেওয়া। সিন্ধু তীরবর্তী ভূখণ্ডের মানুষদের থেকে নিজেদের আলাদা চিহ্নিত করতে প্রতিবেশী মুসলমানরাই এই নাম দিয়েছিলেন। মুসলমান আক্রমণের আগে পর্যন্ত কোনও সংস্কৃত শাস্ত্রগ্রন্থে হিন্দু শব্দটি পাওয়া যাবে না। তাই হিন্দু সমাজ বললে যা বোঝায়, বাস্তবে তার কোনও অস্তিত্বই নেই। হিন্দু বললে আলাদা কোনও বোধ বা অনুভূতির উদ্রেক হয় না। হিন্দুদের এক জাতের সঙ্গে অন্য জাতেরও কোনও সম্পর্ক নেই। একটি জাত অন্য জাতের চেয়ে নিজেকে পৃথক রাখতে সদা-ব্যস্ত।

আম্বেডকর বলছেন, সমাজতাত্ত্বিকরা যাকে বলেন ‘কনশাসনেস অব কাইন্ড’ বা ধরনের চেতনা, তারও কোনও অস্তিত্ব নেই হিন্দু জনমানসে। হিন্দুর সমস্ত চেতনা জুড়ে যা বিরাজ করে, তা হল তার জাতের অস্মিতা, যা সে রক্ষা করতে ব্যতিব্যস্ত। এই কারণেই এ দেশে হিন্দু সমাজ বা হিন্দু নেশন বলে কিছু গড়ে ওঠেনি। হিন্দুরা বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য বিরাজমান বলে পুলকিত হন। কিন্তু আম্বেডকর বললেন, তা দিয়ে ন্যায়নিষ্ঠ, সুষম সমাজগঠন হয় না। রীতি-নীতি-প্রথা-বিশ্বাস এক হলেও মানুষ একই সমাজের অন্তর্গত নাও হতে পারে। আসলে আচার-অনুষ্ঠানের আদান-প্রদানটা বস্তুগত, ব্যবহারিক ও বাস্তবিক হয়ে উঠতে হবে। কয়েকটি ব্যাপারে সাদৃশ্যই সমাজ গঠনের পক্ষে পর্যাপ্ত নয়। বৃহত্তর সমাজ গঠনের জন্য যা অপরিহার্য, তা হল সর্বজনীন অন্তর্ভুক্তিকরণ। হিন্দু সমাজের অন্তর্গত সমস্ত জাতের মানুষ, বিশেষত আদিবাসী, জনজাতি, প্রান্তিক, অস্পৃশ্য, দলিত মানুষজন, সর্বজনীন অধিকারবোধ, অন্তর্ভুক্তিকরণ আর আন্তঃসংযোগ থেকে বঞ্চিত। আম্বেডকরের মতে, জরুরি হল জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষকে সব রকমের সামাজিক কাজে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেওয়া, যাতে তাদের মধ্যে একটি জাতীয় আবেগ জাগ্রত হয় এবং অন্যকেও তা প্রাণিত করে।

আম্বেডকর একটি গুরুতর প্রশ্ন তুলেছিলেন। জাত-ব্যবস্থায় নারীদের কী হবে? তাঁদেরও কি স্বামীদের জাত-ব্যবস্থাতেই ঠাঁই দেওয়া হবে? বিবাহই যদি নারীদের জাত নির্ধারণ করে দেয়, তা হলে চতুর্বর্ণ নিরর্থক হয়ে পড়ে, কেননা জ্ঞান আর কর্ম অনুসারেই জাতিভেদ প্রস্তাবিত হয়েছিল! আর জাত-ব্যবস্থার প্রস্তাবকরা যদি সত্যিই এ-বিষয়ে আন্তরিক হন, তা হলে নারী পুরোহিত, নারী সৈনিক, নারী কসাইকে সামাজিক মান্যতা দিন!

আম্বেডকর জানতেন, জাতের নিগড় থেকে জাতির মুক্তি না মিললে প্রগতির সব পথ রুদ্ধ। তিনি ধর্মের বিরোধিতা করেননি। বার্ক-এর মতো তিনিও বিশ্বাস করতেন, প্রকৃত ধর্মই হল সমাজের ভিত্তি, একটি সুশীল সরকারের সুস্থির বনিয়াদ।

তাই মনু-শাসিত ব্রাহ্মণ্যবাদী বিধান অপসারণ করে, ন্যায়নিষ্ঠ স্বাধীন গণতান্ত্রিক জীবন-ধর্মের প্রতিষ্ঠা চেয়েছিলেন তিনি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement