বড় মাপের প্রজ্ঞার অন্যতম প্রধান ধর্ম এই যে, তা গভীর ও জটিল সমস্যার মুখোমুখি হয়ে তার জটিলতার গোলকধাঁধায় পথ হারায় না, অগভীর উপরিতলেও নিজেকে সীমিত রাখে না, সমস্যার মর্মস্থলে আলো ফেলে, সমস্যা মোকাবিলার পথটিও চিনিয়ে দেয়। অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের লেখায়, বক্তৃতায় ও আলোচনায় দারিদ্র, অসাম্য ও মানব উন্নয়ন সংক্রান্ত প্রশ্নে বহু কাল ধরে এই অন্তর্ভেদী প্রজ্ঞার অগণন পরিচয় পাওয়া গিয়েছে। সম্প্রতি আরও এক বার তারই নিদর্শন মিলল কর্মসংস্থানের ঘাটতি বিষয়ক তাঁর একটি মন্তব্যে। এ দেশে বেকারত্বের সমস্যা ভয়াবহ। দেশের বর্তমান শাসকরা তাঁদের রাজত্বের শুরু থেকেই ছলে বলে ও রকমারি কৌশলে সেই সমস্যাকে অস্বীকার করার এবং ধামাচাপা দেওয়ার বহু চেষ্টা চালিয়েও সত্য গোপন করতে পারেননি: এ-কথা এখন অবিসংবাদিত যে, ভারতে যথার্থ সম্মানজনক এবং উপার্জন প্রদায়ী কাজের সুযোগ অত্যন্ত কম, তার প্রসারও অতিমাত্রায় সঙ্কুচিত। সচরাচর এই সঙ্কটের কারণ হিসাবে বিনিয়োগের অভাব, প্রযুক্তির যন্ত্রনির্ভরতা, চাহিদার অপ্রতুলতা ইত্যাদি কারণকে দায়ী করা হয়। কারণ হিসাবে প্রত্যেকটিই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তার পাশাপাশি অন্য একটি সমস্যাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয় না। তার নাম শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ঘাটতি। অমর্ত্য সেন বরাবরই সেই ঘাটতির উপর সমধিক জোর দিয়ে এসেছেন। কেন জোর দেওয়া দরকার, সে-কথা তিনি দেশের বর্তমান পরিস্থিতির ভিত্তিতেই আরও এক বার মনে করিয়ে দিয়েছেন।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের প্রসার যে মানব উন্নয়নের অপরিহার্য অঙ্গ, সে-কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, অমর্ত্য সেন নিজেও তা ক্রমাগত বলে এসেছেন। কিন্তু কেবল উন্নয়নের অঙ্গ হিসাবে নয়, তার প্রকরণ বা উপায় হিসাবেও শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য অপরিহার্য। কর্মসংস্থান এই পরিপ্রেক্ষিতেই গুরুত্বপূর্ণ। একটি দেশের নাগরিকরা সুস্থ, স্বাস্থ্যবান এবং সুশিক্ষিত হলে তবেই তাঁদের যথাযথ কাজের সুযোগ বাড়ে— অপুষ্ট, অসুস্থ, অ-শিক্ষিত জনসমষ্টি সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়, এই সত্যটি এত দিনে দুনিয়া জুড়ে প্রমাণিত। শিক্ষা অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে কর্মসংস্থান এবং উপার্জনের জোরদার সম্পর্ক বহু দিন ধরে বহু দেশে বহু সমীক্ষায় ও গবেষণায় সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অথচ এ দেশের শাসক ও নীতিকাররা সেই বিষয়ে যথেষ্ট মনোযোগী হননি, কিছু কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে দেশ জুড়েই শিক্ষার প্রতি শাসকদের বিপুল ঔদাসীন্য এক অনড় ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। আজ কর্মসংস্থানের সম্পূর্ণ বেহাল অবস্থার পিছনে সেই ঔদাসীন্যের ভূমিকা বিপুল।
ঔদাসীন্যের বহু রূপ, বহু মাত্রা। কিন্তু তার একটি একেবারে মৌলিক। তা হল অর্থাভাব। দেশের অধিকাংশ অঞ্চলেই কী কেন্দ্র, কী রাজ্য, উভয় স্তরে শিক্ষা খাতে সরকারি বরাদ্দ প্রয়োজনের তুলনায় ক্রমশই সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। পশ্চিমবঙ্গ তার এক ভয়াবহ দৃষ্টান্ত। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, সমস্ত স্তরে বাজেট নেই বলে বহু শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীর শূন্যপদ দীর্ঘকাল ধরে ফাঁকা পড়ে আছে। নানা ভাবে এই ঘাটতি শিক্ষার ক্ষতি করছে। যেমন, সম্প্রতি একই দিনে প্রকাশিত হয়েছে দু’টি সংবাদ। এক দিকে, কলেজের অধ্যক্ষদের একটি সংগঠন শিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মীর প্রবল অভাব নিয়ে গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে। অন্য দিকে, উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে বৃত্তিশিক্ষার ক্ষেত্রে সিমেস্টার ব্যবস্থা চালু করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, অথচ সেই ব্যবস্থার উপযোগী পরিকাঠামো নেই। এই দু’টি নিতান্তই দৃষ্টান্তমাত্র। সরকারের এই অসহযোগের পরিণামে রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থাটি কার্যত ধূলিসাৎ হয়েছে। অর্থাৎ, কর্মসংস্থান এবং সুষম সর্বজনীন মানব উন্নয়নের জন্য যে বিষয়ে মন দেওয়া সরকারের প্রাথমিক কর্তব্য, সেই বিষয়েই তাদের চূড়ান্ত ঔদাসীন্য। তবে, সন্দেহের অবকাশ কোথায় যে এই দুর্ভাগা দেশে অমর্ত্য সেনের কথাগুলি অরণ্যে রোদন মাত্র।