কেউ বেআইনি কাজ করলে তার আইনসম্মত তদন্ত ও অভিযোগ প্রমাণিত হলে আইনমাফিক শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে— স্বাভাবিক। কিন্তু যাঁরা সে ব্যবস্থা করবেন, তাঁরাই যদি আইন ভঙ্গ করেন? সর্ষের মধ্যেই যদি থাকে ভূতপ্রেত? দুর্নীতি বিষয়ক তদন্ত নিয়ে ইডি যে ভাবে রাহুল গান্ধীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে চলেছে, তাতে এই প্রশ্নের ধাক্কায় বিষম অস্বস্তিতে পড়তে হয় বইকি। কংগ্রেসের পক্ষ থেকে গত বুধবার সরকারকে একটি নোটিস ধরানো হয়েছে। বলা হয়েছে যে, দলের নেতা রাহুল গান্ধীর সঙ্গে ইডি-র প্রশ্নোত্তরের কিছু নির্বাচিত অংশ যে রকম আইনবিরুদ্ধ ভাবে প্রচারমাধ্যমে প্রকাশ করা হচ্ছে, এবং তার ভিত্তিতে উদ্দেশ্য-আরোপকারী আলোচনা চলছে, সে বিষয়ে শীঘ্র পদক্ষেপ করা হোক। কংগ্রেস সাংসদ বিবেক তঙ্খা অর্থমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানিয়েছেন, বেনামি সূত্রকে উদ্ধার করে টেলিভিশন চ্যানেলে যে ভাবে এ বিষয়ে রিপোর্ট দেখানো হচ্ছে, তা একেবারেই বেআইনি। কংগ্রেসের অভিযোগটি ভিত্তিহীন নয়। তদন্তের ফল বেরোনোর আগেই রাহুল গান্ধীকে অস্বচ্ছ দেখানোর একটি সংগঠিত প্রচার চলছে, এমন সংশয়ের বিস্তর কারণ আছে। এবং যে ভাবে তদন্তের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রিপোর্টিং চলছে, তাও বেআইনি, সন্দেহ নেই।
ইতিমধ্যে তিন দিন ধরে বহু ঘণ্টাব্যাপী প্রশ্নোত্তরের ধাক্কা রাহুল গান্ধী সামলেছেন। প্রশ্ন তাই নিয়েও। মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, তাঁকে সচেতন ভাবেই নাজেহাল করার বন্দোবস্ত করছে সরকার। ঘটনা হল, এত বেশি সময় ধরে প্রশ্নোত্তর চালিয়ে নাজেহাল করা কি তদন্তের পক্ষে খুব জরুরি? একেবারে প্রথম সারির রাজনৈতিক নেতা থেকে সাধারণ নাগরিক, যে কোনও মানুষের পক্ষেই কি এই ব্যবহার অন্যায়, অযৌক্তিক নয়? এ-হেন জিজ্ঞাসাবাদ কি প্রায় নির্যাতনের পর্যায়ে পড়ে না? প্রসঙ্গত, পশ্চিমবঙ্গের সাংসদ অধীররঞ্জন চৌধুরীর মন্তব্যটি মনে করা যেতে পারে। তিনি বলেছেন, বিরোধী নেতারা তো ঠিক সন্ত্রাসবাদী নন যে তাঁদের সঙ্গে এতখানি দুর্ব্যবহার করা হবে। দলের নেতা-সমর্থকরা যখন তাঁদের দলের নেতার প্রতি সহমর্মিতা জানাতে চেয়েছেন, সেটুকুও করতে দেওয়া হয়নি। সরকারি অবস্থান ও বিরোধী অবস্থানের মধ্যে রাজনৈতিক সংঘাত স্বাভাবিক, কিন্তু পুরো ছবিটা যেন বলে দেয়, বিরোধী নেতা অপরাধী— এই কথাটি আগেভাগেই জনমানসে প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চলছে, তদন্তের ফল যা-ই হোক না কেন।
বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ দু’টি কারণে। প্রথমত, গণতান্ত্রিক দেশে বিরোধিতার অধিকার এবং বিরোধী নেতার মানবাধিকার নিয়ে যে ধরনের সুরক্ষা ব্যবস্থা আছে, তা মেনে চলাটা কিন্তু গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত হয়ে আসা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। দ্বিতীয়ত, গোটা দেশেই বিরোধী ও সমালোচকদের আইনের সাহায্য নিয়ে ও আইনের ফাঁকের সুযোগ নিয়ে অপদস্থ ও বিপন্ন করা হচ্ছে— আবারও সে কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে ইডি-র এই তদন্ত। ঠিকই, ইডি-র মতো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা কী ভাবে তদন্ত করবে তা নিতান্ত তাদেরই বিষয়। কিন্তু পদ্ধতির মধ্যে অমানবিকতার পরিমাণটি দেখায় যে, সত্য উদ্ঘাটনের লক্ষ্যকে ছাপিয়ে যাচ্ছে আর একটি প্রচ্ছন্ন কিন্তু প্রবল লক্ষ্য: বিরোধী নেতাকে যেন তেন প্রকারেণ বিপন্ন করা। সে দিক থেকে দেখলে, গোটা ঘটনাটি তাই কেবল বিরোধী দলের জন্য দুর্ভাগ্যজনক নয়, দেশের সার্বিক গণতন্ত্রের আবহের পক্ষেই বিপজ্জনক। দেশের প্রধান বিরোধী দলের প্রধান নেতাকে যদি এতখানি নাজেহাল করার চেষ্টা হয়, সাধারণ নাগরিক তা হলে সরকারি তদন্তকারী কিংবা আইনরক্ষকদের কাছে কেমন ব্যবহার আশা করবেন? না কি, কখনও কখনও অভিযোগ প্রমাণের রাস্তাটি কঠিন বলেই প্রমাণের পদ্ধতিটিকে আগে থেকেই কঠোরতর পর্যায়ে নিয়ে যেতে হয়?
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।