প্রতীকী ছবি।
কূটনীতিতে সহজ কথার কদর নাই, কিন্তু কূটনীতির সত্য সহজ করিয়া বলা শ্রেয়, বিশেষত সত্যটি যখন সুকঠিন। কাবুলে তালিবান জমানার প্রত্যাবর্তন ভারতের পক্ষে নিরাপত্তা এবং ভূ-রাজনীতি, দুই দিক দিয়াই উদ্বেগজনক। তালিবানদের মিত্র জঙ্গি গোষ্ঠীগুলি কয়েক দশক যাবৎ কাশ্মীরে উপদ্রব সৃষ্টিতে তৎপর। কাবুলের নূতন ঘাঁটি হইতে সেই তৎপরতা বৃদ্ধির আশঙ্কা রহিয়াছে। পাকিস্তানের রাষ্ট্র তথা সামরিক ছাউনির তালিবান-সংযোগ গভীর এবং ব্যাপক। ফলে, কাশ্মীরে নূতন গোলযোগ সৃষ্টিতে ইসলামাবাদ এবং কাবুল, দুই তরফের সম্মিলিত উদ্যম তীব্রতর হইতেই পারে। তাহার উপরে রহিয়াছে নূতন ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণের চিন্তা। আফগানিস্তান হইতে আমেরিকার অপসরণের ফলে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলটিতে চিন-রাশিয়া-পাকিস্তান অক্ষের গুরুত্ব অনেকখানি বাড়িবে। অক্ষটি নিটোল বন্ধুত্ব বা সংহতির নহে, রাশিয়ার সহিত চিনের বহুমাত্রিক দ্বন্দ্ব রহিয়াছে। অন্য দিকে, আফ-পাক সীমান্তের সংজ্ঞা ও নিয়ন্ত্রণ লইয়া তালিবান-শাসিত কাবুলের সহিত ইসলামাবাদের টানাপড়েনও অনিবার্য। কিন্তু সেই সব দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়া আঞ্চলিক কূটনীতি যে পথেই চলুক, তাহা ভারতের স্বার্থের অনুকূল হওয়া কার্যত অসম্ভব।
ভারতের সমস্যার মূলে দুইটি সত্য। এক, আমেরিকা সরিয়া যাইবার পরে আঞ্চলিক শক্তির কূটনৈতিক প্রভাব বিস্তারের সুযোগ আসিবে, সুতরাং চিনের প্রতিপত্তি বাড়িবে, যাহা ভারতের স্বার্থের প্রতিকূল। দুই, ভারতকে এই অঞ্চলের ভূ-রাজনীতিতে আপন ‘প্রতিনিধি’ হিসাবে ব্যবহার করিবার যে তাগিদ ওয়াশিংটন দেখাইয়া আসিতেছিল, যে তাগিদের উপর দিল্লির নায়করা নির্ভরশীল ছিলেন, ট্রাম্প-উত্তর আমেরিকার বিদেশ নীতিতে সেই তাগিদটি বহুলাংশে দুর্বল— প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ‘ঐতিহাসিক’ ভাষণেও তাহা স্পষ্ট। অর্থাৎ, কার্যত নিঃসঙ্গ ভারত শত্রুপরিবৃত না হউক, বন্ধুপরিবৃত নহে। তাহার কূটনৈতিক পদক্ষেপের সুযোগ সীমিত। তালিবান সরকারকে স্বীকৃতি দিবার প্রশ্নেও তাহাকে সন্তর্পণে পা ফেলিতে হইবে। বিদেশমন্ত্রী রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে সন্ত্রাসের কথা বলিয়া তালিবানের উপর চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করিয়াছেন, আবার একই সঙ্গে তাহাদের সরকারের সহিত ‘কাজের সম্পর্ক’ চালু রাখিবার প্রস্তাবও হাওয়ায় ভাসানো হইয়াছে। ইহার বাস্তব সম্ভাবনা কতটুকু? আফগানিস্তানে ভারতের ৩০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ, পরিকাঠামো উন্নয়নে ভারতের ভূমিকা ইত্যাদি নানা নজির দেখানো হইতেছে বটে, কিন্তু তালিবানি আফগানিস্তানে, এবং তাহার পাশে চিন থাকিতে, এই সব উন্নয়নী সহযোগিতার মূল্য কয় আনা? এই পরিস্থিতির পিছনে মোদী সরকারের কূটনৈতিক ব্যর্থতা অবশ্যই অংশত দায়ী, তবে তাহা লইয়া বাক্যব্যয় অর্থহীন— সমস্ত বিষয়ে অপদার্থতাই এই সরকারের শিরোভূষণ।
কিন্তু সমস্যার সেখানেই শেষ নহে। ভারতবাসীর শঙ্কিত বোধ করিবার একটি বিশেষ কারণ আছে। নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁহার দল তালিবানদের অভ্যুত্থানকে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির প্রকরণ হিসাবে ব্যবহার করিতে তৎপর হইবেন, তাহার আশঙ্কা প্রবল। ইতিমধ্যেই নির্বাচন-অভিমুখী উত্তরপ্রদেশে তাহার দুর্লক্ষণ রীতিমতো স্পষ্ট। বিভাজন এবং বিদ্বেষের রাজনীতি দেশের বিপুল ক্ষতি সাধন করিয়াছে। সেই আগুনে ‘তালিবানি ইন্ধন’ পড়িলে বিপদ বাড়িবে। বাহিরের বিপদ অপেক্ষা ঘরের বিপদ অনেক বেশি উদ্বেগজনক। যোগী আদিত্যনাথ প্রমুখ নায়কদের শুভবুদ্ধির উপর ভরসা করিবার অবকাশ কম, দেশের রাজনৈতিক এবং সামাজিক পরিসরে শুভবোধসম্পন্ন নাগরিকদের সমবেত উদ্যোগ জরুরি। তালিবানরা কাবুল জয় করিয়াছে, ভারতীয় রাজনীতিতে তালিবানদের এই উত্থানকে ব্যবহার করিতে দেওয়া চলিবে না।