ভারতের রাষ্ট্রপতির নাম দ্রৌপদী মুর্মু, এই সত্য নিজগুণেই ঐতিহাসিক। এর পিছনে আছে এক দীর্ঘ অপ্রাপ্তি ও বঞ্চনার ইতিহাস। এক জন আদিবাসী নাগরিককে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদটিতে অধিষ্ঠিত হওয়ার জন্য সাত দশকের বেশি সময় অপেক্ষা করতে হল। এই অপেক্ষায় দেশের, বিশেষত ক্ষমতাবান উচ্চবর্গের যে অগৌরব নিহিত, ওড়িশার জনজাতি-কন্যার নবলব্ধ গৌরব তাকে দূর করতে পারবে না। কিন্তু দেশ যে এক নতুন ইতিহাসের পথে অন্তত এক পা অগ্রসর হতে পেরেছে, তার তাৎপর্য তুচ্ছ করার নয়। এই ঘটনাটি যে রাজনৈতিক কৌশলের পরিণাম, তার ইতিবৃত্ত সর্বজনবিদিত। কিন্তু রাষ্ট্রপতির পদে প্রার্থী মনোনয়নের ব্যাপারটা তো অনেক দিন যাবৎই রাজনৈতিক কৌশলের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, এ-কাজ সম্পাদন করতে গিয়ে শাসক বা বিরোধী কোনও পক্ষই আজ আর মহত্তর আদর্শ বা মর্যাদার প্রতি বিশেষ আগ্রহ দেখায় না। অর্থাৎ, সকলেই যে খেলার খেলোয়াড়, নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর সতীর্থরা সেটিতে বিশেষ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন, এই যা। তাতে রাইসিনা হিলস-এ এই অ-পূর্ব আরোহণের ঐতিহাসিকতা কমে না, সেই ইতিহাসের শিখরে উত্তীর্ণ প্রথম নাগরিকের গৌরবও সমুজ্জ্বল থাকে। রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুকে ভারতীয় লোকতন্ত্র অবশ্যই সশ্রদ্ধ অভিবাদন জানাচ্ছে।
অভিবাদন ছাড়া তাঁকে আর কিছু জানানোর অবকাশ আছে কি না, সে-প্রশ্ন অবশ্য খুব সরল নয়। ভারতের শাসনতন্ত্রে রাষ্ট্রপতির নির্ধারিত ভূমিকা নিতান্তই আনুষ্ঠানিক। এই আসনে যাঁরা অধিষ্ঠিত হয়েছেন তাঁরা সকলেই যে সর্বদা সেই আনুষ্ঠানিকতায় নিজের আচরণকে সংযত রেখেছেন, এমন কথা বলা যাবে না। অতিসক্রিয় অনধিকার-চর্চার সেই দৃষ্টান্তগুলি বিপজ্জনক। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে রাষ্ট্রপতির নিজস্ব কোনও ব্যক্তিত্বের পরিচয় দেশবাসী পাবেন না, তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের তথা শাসক দলের তথা মহাশক্তিধর দলনায়কদের ছায়ায় সম্পূর্ণ আবৃত থাকবেন। রাষ্ট্রের এবং সেই রাষ্ট্রের চালক হিসাবে নির্বাচিত সরকারের নৈতিক অভিভাবক হিসাবে রাষ্ট্রপতির একটি ভূমিকা আছে। সেই ভূমিকা খবরদারির নয়, নিয়ন্ত্রণের নয়, পরামর্শদানের। সংবিধানের পরিসরে সুস্থিত থেকে কী ভাবে সেই পরামর্শ দেওয়া যায়, সরকারের কাজে হস্তক্ষেপ না করে কী ভাবে ‘নৈতিক’ প্রণোদনার উৎস হওয়া যায়, তার উৎকৃষ্ট নিদর্শন সাত দশকের ইতহাসে বিরল নয়। তেমন দৃষ্টান্ত আগামী পাঁচ বছরে রচিত হবে কি না, জানবার জন্য লোকতান্ত্রিক ভারত আগ্রহী থাকবে।
নতুন রাষ্ট্রপতির পরিচিতির কারণেই আগ্রহের একটি বাড়তি মাত্রা আছে। ভারতে জনজাতীয় নাগরিকরা আজও যে ব্যাপক ও গভীর বঞ্চনা, বৈষম্য ও নিপীড়নের শিকার, আদিবাসী রাষ্ট্রপতির কল্যাণে সেই অন্যায়ের ইতিহাস কিছুমাত্র বদলাবে কি? এ-সংশয় এই কারণে গভীরতর হয়ে ওঠে যে, বর্তমান শাসকদের আচরণে জনজাতির মর্যাদা, অধিকার এবং স্বাতন্ত্র্যের প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধার পরিচয় একেবারেই বিরল, বরং ‘অখণ্ড হিন্দুত্বের’ ছাঁচে ঢেলে দলে টানার তাগিদে তাঁদের শিক্ষা-সংস্কৃতি-ধর্মাচরণের স্বাধিকার হরণের নানা উদ্যোগ থেকে শুরু করে সাঙাততন্ত্রের প্রভাবে তাঁদের আরণ্যক বাসভূমি থেকে উৎখাত করার প্রকল্প অবধি বিভিন্ন প্রকরণ ব্যবহার করে আদিবাসীদের বিরুদ্ধে ক্ষমতাবানের চিরাচরিত অভিযান এই জমানায় আরও জোরদার হয়েছে। আদিবাসী ব্যক্তি-নারীকে শীর্ষাসনে বসিয়ে যদি সেই আগ্রাসনের বাস্তবকে আড়াল করার চেষ্টা চলে, তবে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু কেবল প্রতীক হয়েই থাকবেন না, সেই প্রতীক এক অন্যায় ব্যবস্থাকে আড়াল করার মোহ-আবরণ হিসাবে কাজ করবে। কেবল আদিবাসী ভারতীয় নন, প্রতিটি সুচেতন নাগরিক আশা করবেন, সেই দুর্ভাগ্যের বোঝা তাঁদের বহন করতে হবে না।