বিমার ব্যবসা করা কি সরকারের কাজ? স্বাভাবিক বুদ্ধি বলিবে, না। সরকারের কাজ হইল বিমার ব্যবসার বাজারটিকে সচল রাখা; কেহ যাহাতে কোনও অবৈধ উপায় অবলম্বন না করে, তাহা নিশ্চিত করা; গ্রাহকের স্বার্থ রক্ষা করা ইত্যাদি। ব্যবসার কাজটি বাণিজ্যিক সংস্থার হাতে ছাড়িয়া দিলেই মঙ্গল। এবং, গোটা দুনিয়ায় তাহাই দস্তুর। অতএব, সাধারণ বুদ্ধি এই কথাই বলিবে যে, ১৯৭২ সালের সাধারণ বিমা (ব্যবসা) জাতীয়করণ আইন সংশোধন করিয়া রাষ্ট্রায়ত্ত সাধারণ বিমা সংস্থা(গুলি)-র বিলগ্নিকরণের সিদ্ধান্তটিকে স্বাগত জানানোই বিধেয়। বিমার ব্যবসা বেসরকারি হাতে যাওয়া মানেই যে গ্রাহকের স্বার্থ লঙ্ঘিত হওয়া নহে, এই কথাটি এত দিনে স্পষ্ট— গত দুই দশকে ভারতে বিমাক্ষেত্রে যে সংস্কার হইয়াছে, তাহার ফলে দেশের বাজারে এখন বহু বেসরকারি বিমা সংস্থা আছে, এবং তাহাদের ট্র্যাক রেকর্ডে আপত্তিকর কিছু নাই। থাকিবার কথাও নহে— কারণ, প্রতিযোগিতার বাজারে কোনও সংস্থা যদি কাঠামোগত ভাবে গ্রাহকের স্বার্থের পরিপন্থী অবস্থানে থাকে, তবে সেই সংস্থাটি বাজারে টিকিতে পারিবে না। অতএব, বিলগ্নিকরণের বিরুদ্ধে যাঁহারা মিটিং-মিছিল করিতেছেন, এবং তাহাতে গ্রাহকের স্বার্থহানির আশঙ্কা শুনাইতেছেন, তাঁহারা প্রতিযোগিতার বাজারের ধর্ম বুঝিয়া উঠিতে পারেন নাই।
কিন্তু, এই কথাও বলিবার নহে যে, আশঙ্কার কোনও কারণই নাই। সাধারণ বিমা সংস্থার বিলগ্নিকরণই হউক, বা জীবনবিমা নিগমের শেয়ার বিক্রয়ের সিদ্ধান্ত— প্রতিটি ক্ষেত্রেই কিছু বিষয়ে সচেতন থাকা বিধেয়। জীবনবিমা নিগমের উদাহরণটিই লওয়া যাউক। ভারতের বাজারে এখন ২৩টি বেসরকারি জীবনবিমা সংস্থা আছে, কিন্তু বাজারের তিন-চতুর্থাংশ এখনও রাষ্ট্রায়ত্ত এলআইসি-র দখলে। অর্থাৎ, জীবনবিমার বাজারটি এখনও রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত। সেই বাজারে কী ঘটিবে, তাহা বহুলাংশে নির্ভর করে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটির সিদ্ধান্তের উপরই। বাজার হইতে এই বৃহৎ সংস্থাটিকে যদি সরাইয়া লওয়া যায়, অথবা তাহা যদি বেসরকারি মালিকানার অধীন হয়, তবে বাজারের চরিত্রটিও সম্পূর্ণ বদলাইয়া যাইতে পারে। এযাবৎ কালের অভিজ্ঞতা হইতে সেই পরিবর্তিত বাজারের চলন আঁচ করা যাইবে না। এই ক্ষেত্রে উপযোগী হইতে পারে অন্য দেশের অভিজ্ঞতা। তবে, আমেরিকার ন্যায় পরিণত আর্থিক বাজারের সহিত তুলনা করিলে তাহা যথাযথ হইবে না— যে দেশগুলির আর্থিক বাজারের অবস্থা ভারতের তুল্য, তেমন বাজারের সহিত তুলনা করাই বিধেয়।
আর্থিক বাজারের চরিত্রের প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ। যে আর্থিক বাজার যত পরিণত, সেখানে জনসংখ্যার তত বেশি অংশ সেই বাজারের অন্তর্ভুক্ত। ভারতের ন্যায় দেশে জনসংখ্যার একটি বিপুল অংশ এখনও প্রাতিষ্ঠানিক আর্থিক বাজারের বাহিরে। তাঁহাদের নিকট যেমন ঋণের সুবিধা পৌঁছায় না, তেমনই পৌঁছায় না বিমাও। ফলে, নাগরিক হিসাবে যে আর্থিক সুরক্ষা তাঁহাদের প্রাপ্য, তাহা অধরাই থাকিয়া যায়। মূল প্রশ্ন এইখানেই— বাজার যদি বেসরকারি বিমা সংস্থা দ্বারা চালিত হয়, তবে কি আর্থিক অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি ধাক্কা খাইবে? এই প্রশ্নের উত্তর যাহাতে বৃহত্তর সমাজের অনুকূলে থাকে, তাহা নিশ্চিত করিবার দায়িত্ব সরকারের। সরকারি সংস্থা ব্যবসা করিতেছে, না কি বেসরকারি সংস্থা— প্রকৃত প্রস্তাবে ইহা গুরুত্বহীন; মূল প্রশ্ন হইল, যে সংস্থাই ব্যবসা করুক, সকল নাগরিকের নিকট পরিষেবা পৌঁছাইয়া দিতে সরকার তাহাদের বাধ্য করিতে পারিতেছে কি না। যদি পারে, তাহা হইলে বিমা সংস্থার বিলগ্নিকরণে বিন্দুমাত্র ক্ষতি নাই, বরং লাভ। প্রশ্ন হইল, সরকারের সেই সদিচ্ছা আছে কি? বাজারকে আরও কুশলী, আরও উৎপাদনশীল করিয়া তোলা, না কি সাঙাতদের সুবিধা করিয়া দেওয়া, সংস্কারের মূল উদ্দেশ্যটি কী?