ভারতীয় সংবিধান কার্যকর হওয়ার বছরখানেক পরে, ১৯৫১ সালের ১০ মে তার প্রথম সংশোধনী আইন-প্রস্তাবটি সংসদে পেশ করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। সেই ঐতিহাসিক উপলক্ষে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে তিনি যে বক্তৃতা করেন, তার একটি বাক্য তর্জমা করলে দাঁড়ায় এই রকম: “এখন, আমার নিজের মতটা হল, ওই বিশেষ ধারাটি (ভারতীয় দণ্ড বিধির ১২৪ক ধারা) অত্যন্ত আপত্তিকর এবং জঘন্য; আমরা যত রকমের আইন প্রণয়ন করি না কেন, বাস্তব এবং ইতিহাস— কোনও দিক থেকেই সেখানে এই ধারাটির কোনও স্থান থাকা উচিত নয়।” নেহরু-সমালোচিত এই ধারাটিই রাষ্ট্রদ্রোহ আইন নামে পরিচিত। সেই আবেগদীপ্ত ভাষণের পরে সাত দশক কেটে গিয়েছে, যে সুদীর্ঘ কালপর্বের প্রথম সতেরো বছর প্রধানমন্ত্রীর আসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন নেহরু নিজেই। ভারতীয় দণ্ড বিধির ১২৪ক ধারা আজও, সাহেবি কেতায় বললে, বেঁচে আছে এবং লাথি ছুড়ছে। এমনও বলা যেতে পারে যে, তার লাথির দাপট সে দিনের তুলনায় বহুগুণ বেড়েছে। আজকের দেশের শাসকের সমালোচনা করলে সেই সমালোচককে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে দমন-পীড়নের যে সব নজির এ কালে রচিত হয়েছে এবং হয়ে চলেছে, তা এই আইনের স্রষ্টা ব্রিটিশ প্রভুদেরও হার মানায়।
একা নেহরুকে দোষ দিয়ে লাভ নেই, সাত দশকে কত সরকার এল গেল, কত নায়ক-নায়িকা রাজত্ব করলেন এবং করছেন, ১৮৭০ সালে ব্রিটিশ রাজের প্রবর্তিত রাষ্ট্রদ্রোহ আইন নড়ল না। ইতিমধ্যে, ২০০৯ সালে, খাস ব্রিটেনে এই আইন বাতিল হয়েছে, যেমন বাতিল হয়েছে আমেরিকার বিভিন্ন রাজ্যে, নিউ জ়িল্যান্ডে, আরও নানা দেশে। একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকারের সমালোচনা করলে ‘জনপরিসরের শৃঙ্খলা’ বিনষ্ট হতে পারে, এই অজুহাত দেখিয়ে নাগরিকদের দিনের পর দিন কয়েদ করে রাখা যায় অথবা গ্রেফতার করার ভয় দেখিয়ে তাঁদের জীবন দুর্বিষহ করে তোলা যায়, এর চেয়ে বড় স্বৈরতান্ত্রিক অনাচার কমই হয়। অন্যে পরে কা কথা, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি কয়েক মাস আগে মন্তব্য করেছিলেন, “রাষ্ট্রদ্রোহ (আইন) যে ভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, (সেটা দেখে মনে হতে পারে) যেন কাঠুরিয়াকে এক টুকরো কাঠ কাটতে একটা করাত দেওয়া হয়েছে আর তিনি সেই করাত দিয়ে গোটা বনটাই কেটে ফেলছেন।”
প্রধান বিচারপতির প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা জানিয়ে একটি কথা বলা দরকার। রাষ্ট্রনায়কদের মতিগতি যা দাঁড়িয়েছে, তাতে করাত হাতে পেলে তাঁরা কাঠের টুকরো কেটে থামবেন বলে বিন্দুমাত্র ভরসা হয় না, বরং সমস্ত বিরোধিতা, সব সমালোচনা, যাবতীয় বিরোধী স্বর, এমনকি সামান্যতম অস্বস্তিকর প্রশ্নও যাতে নির্মূল করা যায় সে জন্য ‘সিডিশন’ ‘সিডিশন’ বলে করাত চালিয়ে যাবেন, এটাই তাঁদের পক্ষে ‘স্বাভাবিক’। সুতরাং, গণতন্ত্রের দোহাই, করাতটি তাঁদের হাত থেকে অবিলম্বে কেড়ে নেওয়া হোক। দণ্ড বিধির ১২৪ক ধারা পত্রপাঠ বাতিল হোক। স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পূর্তিতে সেটাই হবে ভারতীয় সাধারণতন্ত্রের এক ঐতিহাসিক প্রাপ্তি। এই দাবি জানানোর পক্ষে এখন অতি প্রশস্ত সময়। আজ সর্বোচ্চ আদালতে একটি আবেদনের বিচার শুরু হওয়ার কথা। রাষ্ট্রদ্রোহ আইনকে অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করে সেটি রদের এই আবেদন পেশ করেছেন এক অবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসার, এক প্রাক্তন মন্ত্রী তথা সাংবাদিক, ও সাংবাদিক-সম্পাদকদের একটি সংগঠন। নাগরিক সমাজ থেকে এই দাবি ইতিমধ্যে উঠেছে বার বার। এখন দেশের মহামান্য আদালত এই বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নেন, কেবল দেশের মানুষ নয়, গণতান্ত্রিক দুনিয়া তার অপেক্ষায় থাকবে। শাসকরা সেই দুনিয়ার শরিক হবেন, না করাতটি কুক্ষিগত রাখবেন— তাঁদেরই ঠিক করতে হবে।