অঞ্জলি সিংহের হত্যার ঘটনায় ফের দেশবাসীর শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বইয়েছে। ফাইল চিত্র।
বিরল থেকে বিরলতম অপরাধ ভারতে কত সহজে ঘটে যায়, তার নিদর্শন ফের দেখা গেল রাজধানীতে। যা ছিল পথ-দুর্ঘটনা, তা পরিণত হল এক ভয়ানক হত্যাকাণ্ডে, পুলিশ কার্যত বিনা বাধায় তা ঘটতে দিল। প্রত্যক্ষদর্শীর উপর্যুপরি সতর্কবার্তা উপেক্ষিত হল। কুড়ি বছরের অঞ্জলি সিংহের ক্ষত-বিক্ষত দেহ চাকায় জড়িয়ে একটি গাড়ির পাঁচ আরোহী দিল্লির সুলতানপুরী ও কানঝাওয়ালা এলাকায় দেড় ঘণ্টা ধরে অবাধে ঘুরল। প্রায় তেরো কিলোমিটার পথে মন্থরগতিতে চলা এই গাড়িটিকে আটকানো, আহতকে উদ্ধার করা, চালক ও আরোহীদের আটক করার কোনও চেষ্টাই দেখা গেল না টহলরত পুলিশদের। বিষয়টির প্রত্যক্ষ সাক্ষী এ বিষয়ে সরব না হলে, সর্বসমক্ষে ঘটনাটি তুলে না ধরলে, এবং পুলিশের বিরুদ্ধে নাগরিক রোষ আছড়ে না পড়লে হয়তো এই হত্যা আরও একটি পথ-দুর্ঘটনা হয়ে লেখা হত পুলিশের খাতায়। ঘটনার যে পরম্পরা সামনে এসেছে, তাতে ‘আইনের শাসন’ কথাটাই তিক্ত পরিহাস বলে মনে হয়। নতুন বছরের প্রথম দিনে ফের স্পষ্ট হল, ‘নাগরিকের সুরক্ষা’ একটি ধারণামাত্র, পুলিশ-প্রশাসনের কাছে প্রকৃত কর্তব্য হয়ে উঠেছে চাকরিরক্ষা। অপরাধ কত গুরুতর, তার চাইতেও পুলিশকর্মীদের কাছে বড় হয়ে উঠেছে অভিযুক্ত কত প্রভাবশালী, সেই প্রশ্ন। আটক হওয়ার পরে গাড়ির আরোহীরা পুলিশের কাছে নিজেদের মত্ততার কথা স্বীকার করেছে, অথচ ইংরেজি নববর্ষের রাতে রাস্তায় তাদের আটকে কথাবার্তার পরেও ছেড়ে দিয়েছে পুলিশ, এ তথ্য শিহরিত করে। অভিযুক্তদের সঙ্গে বিজেপি দলের সংযোগের জন্যই পুলিশ এমন ‘বিষহীন সাপ’ হয়ে উঠল কি না, সে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। বিজেপির কিছু শীর্ষ নেতা অভিযুক্তদের সপক্ষে সরব হয়েছেন, শোনা যাচ্ছে।
অঞ্জলি সিংহের হত্যার ঘটনায় ফের দেশবাসীর শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বইয়েছে, কারণ গাড়ির চাকার নীচে ওই ক্ষত-বিক্ষত দেহে বসিয়ে নেওয়া যায় এ দেশের নিরানব্বই শতাংশ মানুষের মুখ। ক্ষমতাই যেখানে শেষ কথা, সেখানে ন্যায়, সাম্য, ব্যক্তিমর্যাদাকে চাকায় জড়িয়ে যেমন খুশি ঘুরতে পারে ক্ষমতাসীন। অপরাধ ও অপরাধীর প্রতি পুলিশের প্রশ্রয়ের নকশাটি অপরাধপ্রবণ ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগুলি ভালই বোঝে। রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টির ক্ষমতা যাদের নেই, তাদের প্রতি পুলিশের উপেক্ষা, তাচ্ছিল্য, এমনকি হিংস্রতার কথা কে না জানে? যারা সহায়হীন, সমাজ-সংসারের চোখে সন্দেহজনক, তারা অতএব ‘সহজ শিকার’। রাতের নগরপথে একা তরুণীর উপর জঘন্যতম অপরাধ ঘটানোর পরেও অপরাধীরা তাই নিশ্চিন্তে থাকে। দিল্লিতে নির্ভয়াকে গণধর্ষণ ও হত্যার পরে অভিযুক্তরা যথারীতি কাজে যোগ দিয়েছিল। হায়দরাবাদে পশুচিকিৎসক তরুণীকে ধর্ষণ ও দগ্ধ করার পরে, হাথরসে দলিত তরুণীর গণধর্ষণের পরেও অভিযুক্তরা এলাকাতেই ছিল। দিল্লির সুলতানপুরীতে কি তারই পুনরভিনয় হল না? হয়তো এই ঘটনার শুরু এক দুর্ঘটনা দিয়ে। কিন্তু তার পর যা কিছু ঘটেছে, তাতে হত্যাকারীর মানসিকতা স্পষ্ট। এক অপরিচিত তরুণীকে যন্ত্রণাময় মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া, টহলরত পুলিশকে বিভ্রান্ত করা অথবা ভীতিপ্রদর্শন, এ সব কিছুর মধ্যেই আইন-প্রশাসনকে ‘বুঝে নেওয়া’র প্রবণতা ফুটে ওঠে— যা দুর্বলের প্রতি নির্যাতনকে প্রায় অবধারিত করে তোলে।