তাঁহার সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে এমন বিপুল জনসভা তিনি দেখেন নাই, বলিয়াছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। জনসমাগমের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে সাত তারিখের ব্রিগেড সভা প্রথম সারিতে ঠাঁই পাইবে না। কিন্তু, পাঁচ বৎসর পূর্বেও এই রাজ্যে যে দলটির অস্তিত্ব ছিল অকিঞ্চিৎকর, সেই দলটিই রাজ্যের অন্যতম রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হইয়াছে— রবিবারের জনসভা হইতে এই কথাটি বিলক্ষণ পড়িয়া লওয়া চলে। বিজেপির কৃতিত্ব, বিলক্ষণ— কিন্তু রাজ্যের অন্য বিরোধী দলগুলির ব্যর্থতাও বটে। বিরোধী রাজনীতির পরিসরটি তাহারা স্বেচ্ছায় মুরলীধর সেন লেনে সমর্পণ করিয়া দিয়াছে। বিজেপির শক্তি প্রদর্শন ছাড়াও রবিবারের সভা আরও কয়েকটি কথা স্পষ্ট করিয়া দিল। প্রধানমন্ত্রী ২০১১ সালের ‘পরিবর্তন’-এর প্রসঙ্গ তুলিয়া বলিয়াছেন, মানুষ যে আশা লইয়া তখন তৃণমূল কংগ্রেসকে ভোট দিয়াছিল, সেই আশা পূর্ণ হয় নাই, ফলে এই বার বিজেপি ‘প্রকৃত পরিবর্তন’ ঘটাইবে। ২০১৪ সালে যে প্রতিশ্রুতিগুলি ছিল, সেগুলির বাস্তবায়নের কী হইল, প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন নাই। যে পেট্রলকে চল্লিশ টাকা লিটারে নামাইয়া আনিবার কথা ছিল, তাহা কেন একশতের ঘর ছুঁই ছুঁই করিতেছে, সেই কারণও প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে আলোচিত হয় নাই। সে প্রসঙ্গ নাহয় থাকুক। কিন্তু, বামফ্রন্ট হইতে তৃণমূল কংগ্রেসের হাতে শাসনভার যাওয়ায় আর কিছু না হউক, মুখগুলি অন্তত পাল্টাইয়াছিল। এই দফায় সেই সম্ভাবনাটিও ক্ষীণ। ফলে, পরিবর্তনের পুরাতন স্লোগানটি বিজেপি নেতৃত্বের মুখে আরও সারবত্তাহীন শুনাইতেছে।
ইহাও লক্ষণীয় যে, বিজেপির নেতারা অনেক কথা বলিলেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে কেহ সরাসরি দুর্নীতির অভিযোগ করেন নাই। তাঁহাকে বিঁধিতে ‘ভাইপো’-র ঘুরপথে যাইতে হইয়াছে। ইহা নিতান্তই কার্যকারণহীন একটি ঘটনা হইতে পারে— মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে অন্য অভিযোগ তো বিজেপি নেতারা কম করেন নাই। আবার কেহ এই অনুল্লেখের পিছনে গভীরতর কারণ সন্ধানও করিতে পারেন। বলিতে পারেন, দুর্নীতির প্রশ্নটিকে বিজেপি নেতৃত্ব যে আদৌ কোনও গুরুত্বই দেন না, তাহা সংশয়াতীত রকম স্পষ্ট। নচেৎ, তৃণমূল কংগ্রেসের যে নেতাদের নামে দুর্নীতির বিপুল অভিযোগ— অতীতে বিজেপিই যাঁহাদের দুর্নীতির অভিযোগে বিদ্ধ করিত— তাঁহাদের এমন সাদর বরণ করিয়া লওয়া হইত না। অতীতে যাঁহারা গিয়াছেন, শুধু তাঁহারাই নহেন— গত কয়েক মাসে যাঁহারা দল বদলাইয়া বিজেপিতে গিয়াছেন, তাঁহাদের অনেকের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ প্রবল। ফলে, দুর্নীতির প্রশ্নটিকে লইয়া আসর গরম করিবার নৈতিক জোর বিজেপির আর নাই।
‘মানুষের জন্য কাজ’ করিবার আন্তরিক তাগিদে অনেকেই দল বদলাইতেছেন। ঘটনাক্রমে, সেই বদলের অভিমুখটি অদ্বিতীয়— প্রত্যেকেই বিজেপির উদ্দেশে রওনা হইতেছেন। এত দিন রাজনৈতিক দলের সহিত যুক্ত থাকিবার পরও— সাংসদ বা বিধায়ক পদ আলো করিবার পরও— কেন তাঁহারা মানুষের জন্য করিয়া উঠিতে পারেন নাই, এই প্রশ্ন করা অর্থহীন হইবে। কিন্তু, দলবদল করিলেও তাঁহাদের ‘কাজ করিবার তাগিদ’টি পূরণ হইবে কি না, রবিবারের ব্রিগেড সেই প্রশ্নের কোনও নির্ণায়ক উত্তর দিল না। নেতা, অভিনেতা ও অন্যদের যে ঝাঁক সম্প্রতি বিজেপির উপকূলে ভিড়িয়াছে, রবিবারের ব্রিগেডে তাঁহাদের অধিকাংশই তুলনায় গুরুত্বহীন থাকিলেন। কেন, তাহা দলের অভ্যন্তরীণ প্রশ্ন। তবে, কেহ বলিতেই পারেন, যে ভাবে কোনও বাছবিচার ব্যতিরেকেই দলে লোক গ্রহণ চলিতেছে, তাহাতে হয়তো অদূর ভবিষ্যতেই এই দলেও অনেকেরই ‘দমবন্ধ’ হইবার উপক্রম হইবে। তখন শ্বাসবায়ুর সন্ধানে কে কী করিবেন, তাহা একটি প্রশ্ন বটে।