Government vs Governor

দখলদারির লড়াই

সমস্যার ‘সমাধান’ করতে রাজ্যপাল বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থায়ী উপাচার্য নিয়োগ করেন। রাজ্য সরকার তাতে প্রবল আপত্তি জানায়, মামলা করে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৪ অগস্ট ২০২৩ ০৪:২৯
Share:

কেন আপনারা বসে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সমস্যার সমাধান করতে পারেন না? প্রশ্ন তুলেছেন সুপ্রিম কোর্টের মাননীয় বিচারপতি। প্রশ্নের লক্ষ্য এক দিকে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকার, অন্য দিকে এ রাজ্যের রাজ্যপাল। সংবিধান অনুযায়ী যদিও তাঁরা একই দিকে, রাজ্যপাল ‘আমার সরকার’ বলেই ভাষণ দিয়ে থাকেন, কিন্তু দলীয় রাজনীতির মহিমায় বহু দিন ধরেই ‘রাজ্যপাল বনাম রাজ্য সরকার’ লড়াই চলে আসছে। রাজ্যপাল সচরাচর রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্য— এই অযৌক্তিক ঐতিহ্যটির কল্যাণে বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে দাঁড়িয়েছে কেন্দ্র বনাম রাজ্য রাজনীতির এক রণভূমি। হালফিলের পশ্চিমবঙ্গে সেই সংঘাত এক উৎকট রূপ ধারণ করেছে। রাজ্য সরকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগের সুপারিশ পাঠালে আচার্য তাতে সম্মতি দেন না, উপাচার্যের পদ শূন্য পড়ে থাকে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি মহা সমস্যায় পড়ে। এই সমস্যার ‘সমাধান’ করতে রাজ্যপাল বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থায়ী উপাচার্য নিয়োগ করেন। রাজ্য সরকার তাতে প্রবল আপত্তি জানায়, মামলা করে। সেই মামলার শুনানিতেই শোনা গিয়েছে সর্বোচ্চ আদালতের এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি।

Advertisement

সত্য এই যে, আলোচনার মাধ্যমে বিবাদ নিরসনের সদিচ্ছা দুই তরফের কারও আচরণেই দেখা যায়নি। বিশ্ববিদ্যালয়কে উভয়েই দখলদারির জমি হিসাবে ব্যবহার করতে চেয়েছেন, উপাচার্য নিয়োগের প্রক্রিয়া হয়ে উঠেছে তার সুযোগ। বর্তমান রাজ্যপাল দৃশ্যত সেই সুযোগ কাজে লাগানোর এক বিশেষ কৌশল প্রয়োগ করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, তার নাম: একতরফা অস্থায়ী উপাচার্য নিয়োগ। তাঁর কার্যকলাপের আইনি বৈধতার বিচার আদালত করবে, কিন্তু এই ধরনের সিদ্ধান্ত নৈতিকতার প্রশ্ন তুলতে বাধ্য, বিশেষত বিভিন্ন ক্ষেত্রেই যখন অস্থায়ী উপাচার্যদের শিক্ষকতার প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা প্রশ্নাতীত নয়। যেমন, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনিযুক্ত উপাচার্যের রাজনৈতিক ঝোঁক বা সমাজমাধ্যমে তাঁর আপাত-বিচিত্র কার্যকলাপের কথা সরিয়ে রাখলেও তাঁর যোগ্যতা নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছে, তার সদুত্তর রাজ্যপালের কাছে আছে কি? অন্য দিকে, এই পরিস্থিতির দায়ভাগ রাজ্য সরকারও কোনও ভাবেই অস্বীকার করতে পারে না। উপাচার্য নিয়োগের ব্যাপারে সরকার সময় থাকতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ করেছে কি? একতরফা সিদ্ধান্ত নেয়নি কি? শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা নিয়েও কি বড় রকমের প্রশ্ন ওঠে না? তিনি বা তাঁরা একটি গোড়ার কথা বিস্মৃত হয়েছেন: তাঁদের কাজ লড়াইয়ে এবং তরজায় জেতা নয়, রাজ্যের সমস্ত পরিসরে কর্মকাণ্ড ঠিক ভাবে চালানো। বিশ্ববিদ্যালয় তাদের অন্যতম প্রধান পরিসর।

সেই পরিসরে সুস্থ পরিবেশ ও যথাযথ পঠনপাঠনের ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার প্রথম শর্তই কিন্তু দখলদারির মানসিকতা সম্পূর্ণ বর্জন করে বিশ্ববিদ্যালয়ে যথার্থ স্বশাসনের আয়োজন করা। কাজটি সহজ নয়। বিশেষত এখন— যখন দীর্ঘদিনের ক্ষমতাতন্ত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঘুণ ধরিয়ে দিয়েছে, বিভিন্ন কায়েমি স্বার্থ প্রকৃত সংস্কারের যে কোনও আয়োজনে বাধা দিতে কেবল উদ্যত নয়, সিদ্ধহস্ত। সেই বাধা অতিক্রম করতে চাইলে শাসকদের সর্বাগ্রে ক্ষুদ্রস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে যথার্থ শিক্ষক ও শিক্ষাব্রতীদের সাহায্য নিতে হবে। গভীর উদ্বেগের কথা এই যে, তাঁদের আচরণে এর বিপরীত লক্ষণগুলিই প্রকট। এক দিকে সঙ্কটের ‘সুযোগ’ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজে দলীয় আধিপত্য জারির চেষ্টা চলছে, অন্য দিকে চলছে রাজ্যপালের বদলে মুখ্যমন্ত্রীকে আচার্যের আসনে বসানোর তৎপরতা। স্পষ্টতই, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বাধিকার নিয়ে কেউ ভাবিত নয়। এই পরিস্থিতিতে রাজ্যপাল এবং তাঁর কেন্দ্রীয় নিয়োগকর্তারা আপন সাম্রাজ্য বিস্তারের অভিযান চালালে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement