বর্ষাকালে প্রবল বৃষ্টি হইবে, কখনও বা ডিভিসি জল ছাড়িবে, এবং প্লাবিত হইয়া যাইবে ঘাটাল মহকুমার বিস্তীর্ণ অঞ্চল— যুগের পর যুগ এমন ‘ব্যবস্থা’ই বজায় আছে। প্লাবন-পরবর্তী ঘটনাবলিও ন্যূনাধিক জ্ঞাত— কলিকাতা হইতে মোটরযোগে নেতারা আসিবেন, লাইফ জ্যাকেটে সুসজ্জিত হইয়া দুই-একখানি ছবি তুলিবেন, জল জমার সমস্যা মিটাইবার প্রতিশ্রুতি দিবেন এবং লাল ফিতার ফাঁস বিষয়ে ততোধিক শাপশাপান্ত করিবেন; স্থানীয় মানুষ কী বলিতেছেন, সেই কথা যত শুনিবেন, তাহার বহু গুণ বেশি শুনাইবেন স্বরচিত ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। কিছুতেই অবশ্য ঘাটালবাসীর ফি বৎসরের প্লাবনজনিত বিপদে ইতি পড়িবার আশাটুকুও থাকিবে না।
অপিচ, ঘাটালের দুর্ভোগ ঘোচাইতে বিগত ষাট বৎসর যাবৎ এক রাজসূয় যজ্ঞের পরিকল্পনা চলিতেছে। ‘ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান’ নামক এই মহাসমারোহ সেই ১৯৫৯ সালে চূড়ান্ত রূপ পাইয়াছিল। বহু পরে, ১৯৮২ সালে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হইলেও কোনও এক অজ্ঞাত কারণে কাজ শুরু হইতে না হইতেই তাহা বন্ধ হইয়া যায়। ২০০৬ সালে ফের তৎপরতা তৈরি হয়, যদিও কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের যৌথ অনুৎসাহ পুনরায় কাজের সূচনা ঘটাইতে দেয় না। ২০০৯ সাল হইতে ফের কিছু উদ্যোগ দেখা যায়, ২০১৫ অবধি পরিকল্পনা স্তরে সময় ও শ্রম ব্যয়িত হয়, যদিও তৎপরবর্তী ছয় বৎসরে পাতাটিও নড়ে না। এই বারও তাই প্লাবিত ঘাটালে দাঁড়াইয়া মুখ্যমন্ত্রীকে বলিতে হইয়াছে যে, মাস্টার প্ল্যানের অনুমোদনের জন্য ফের কেন্দ্রের দ্বারস্থ হইবেন তিনি। বিগত দশ বৎসরে তাঁহার সরকারের সেচ দফতর এই প্রসঙ্গে একাধিক বার সক্রিয় হইয়াছে; স্থানীয় সাংসদকে লোকসভায় সরব হইতে দেখা গিয়াছে; অভূতপূর্ব ভাবে অর্থব্যয়ের ক্ষেত্রে কেন্দ্র-রাজ্যের ৭৫:২৫ হিসাবটি পাল্টাইয়া ৫০ শতাংশ রাজ্যের ভাগে আসিয়াছে। কিন্তু সকল রাজনৈতিক আগ্রহের পাটিগণিত এত সহজ নহে। তাহা ঘাটালবাসীকে প্রাণে বাঁচাইবার সরল হিসাবে চলে কি না, তাহাতে সন্দেহ। অন্তত, এযাবৎ কালের অভিজ্ঞতা তেমনই বলিতেছে।
সময় যত গড়াইতেছে, খরচের বহরও পাল্লা দিয়া বাড়িতেছে। ১৯৮২ সালে যে প্রকল্পে ব্যয় হইত ৫০ কোটি টাকা, ২০০৯ সালে তাহা ১৭৪০ কোটি টাকায় দাঁড়াইয়াছিল। এই খরচের হিসাব নাহয় রহিল, কিন্তু প্রতি বৎসর বন্যায় ঘাটালবাসীর যে ক্ষতি হইতেছে, তাহার তো হিসাবও নাই! কাহারও আসবাব ভাসিয়া যায়, কাহারও রান্নাঘর তলাইয়া যায়, কাহারও বা বাড়িটিই আর থাকে না। ধান-চাল পচিতে থাকে, পানীয় জল দূষিত হইয়া যায়, এক-একটি উঁচু ভিটায় আশ্রয় প্রার্থনা করেন শত শত প্রতিবেশী। গণরসুই হইতে চিকিৎসা পরিষেবা— এই বারও বহুবিধ প্রশাসনিক সহায়তা মিলিয়াছে। কিন্তু ভৌগোলিক ভাবে অসুরক্ষিত অঞ্চলটির পক্ষে কত দিন এই সঙ্কট লইয়া বাস করা সম্ভব? প্লাবনের প্রাবল্যও ক্রমশ বাড়িতেছে; শিলাবতী কংসাবতী দ্বারকেশ্বর ইত্যাদি যে নদীসমূহ ছোটনাগপুর মালভূমি হইতে ঘাটালের ভিতর দিয়া প্রবাহিত, সেগুলির গর্ভে পলি বোঝাই হইয়া জলধারণ ক্ষমতা কমিতেছে। প্রকৃতির হাতে ছাড়িয়া রাখিলে কোন বিপদের অতলে তলাইয়া যাইবে এই অঞ্চল, তাহা হয়তো অনুমানও করা যাইতেছে না। বন্যা ঠেকাইবার গুরুক্রিয়াটি তাই এই মুহূর্তেই শুরু করা প্রয়োজন।