আশঙ্কা ছিলই— ভারতের উপকূল অঞ্চল নিয়ে। জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কায় সামুদ্রিক জলস্তর বৃদ্ধির প্রভাব যে দেশের এই অংশটির উপর মর্মান্তিক হতে চলেছে, বিশেষজ্ঞরা সেই সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন। সম্প্রতি এক নতুন সমীক্ষাও দেখিয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যেই ভারতের উপকূলে অবস্থিত শহরগুলির বহু অঞ্চল কার্যত সমুদ্রগর্ভে নিমজ্জিত হবে। অর্থাৎ, বিপদ শিয়রে। সংসদে এক প্রশ্নের উত্তরে ভারতের কেন্দ্রীয় পৃথিবী বিজ্ঞান মন্ত্রকের প্রকাশিত সাম্প্রতিক কিছু তথ্যও এই উপকূলীয় সঙ্কটের দিকেই ইঙ্গিত করছে। তথ্যানুসারে, মূল ভূখণ্ডের উপকূল রেখার ৩৪ শতাংশ ইতিমধ্যেই বিবিধ মাত্রায় ক্ষয়ের সম্মুখীন। পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা উদ্বেগজনক। ৫৩৪ কিলোমিটার বিস্তৃত উপকূলরেখা সম্বলিত রাজ্যটিতে ১৯৯০ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলের পরিমাণ ৬০.৫%, দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ।
তবে উপকূলীয় সঙ্কটের সম্পূর্ণ দায় জলবায়ু পরিবর্তনের উপর চাপানো অনুচিত। মানুষের বেআইনি কাজকর্মের দায়ও বড় কম নয়। উপকূলকে রক্ষা করার জন্য ‘কোস্টাল রেগুলেটরি জ়োন’ বা সিআরজ়েড আইন অনুযায়ী, উপকূলের সর্বোচ্চ জোয়ারের জলসীমা থেকে ৫০০ মিটার তটভূমি এলাকায় যে কোনও রকমের নির্মাণকাজে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে সেই আইন কত দূর মানা হচ্ছে? ‘কোস্টাল জ়োন এরিয়া ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান’ পাশ হওয়ার পর তাতে নানা রকম সংশোধনীর মাধ্যমে নির্মাণ সম্পর্কিত বাধানিষেধগুলি শিথিল করা হয়েছে। আইনের ফাঁক গলে মন্দারমণি এলাকায় সমুদ্র তীরে একের পর এক অবৈধ হোটেল গজিয়ে উঠেছে। মৎস্যজীবীদের জায়গা পর্যটন শিল্পের চাপে ক্রমেই সঙ্কুচিত। একই ভাবে আটকানো যায়নি বালি মাফিয়াদের রমরমা। ভারতের বিস্তীর্ণ উপকূল অঞ্চলকে এত কাল রক্ষা করে এসেছে যে ম্যানগ্রোভ অরণ্য, শোচনীয় অবস্থা তারও। এক দিকে উপর্যুপরি ঘূর্ণিঝড় এবং অন্য দিকে নির্বিচারে ম্যানগ্রোভ কেটে বাঁধ, ভেড়ি তৈরির ফলে প্রাকৃতিক রক্ষাকবচটুকুও হারাতে বসেছে। ফলে উপকূল নিয়ে উদ্বেগ অস্বাভাবিক নয়।
মুম্বই, চেন্নাই, কলকাতার মতো বৃহৎ শহরগুলি উপকূলবর্তী। সুতরাং, উপকূল বিপর্যয়ের অর্থনৈতিক ধাক্কাও বড় কম হবে না। তথ্য বলছে, ভারতের বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বইয়ে ২০৫০ সাল নাগাদ শুধুমাত্র জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াতে পারে পঁয়ত্রিশ লক্ষ কোটি টাকা। অন্য দিকে, ভারতের উপকূল অঞ্চল ১৭ কোটি মানুষের বাসস্থান। উপকূলে প্রাকৃতিক বিপর্যয়, সমুদ্রের জলস্তর বৃদ্ধির সরাসরি আঘাত তাঁদের জীবন, জীবিকার উপরেই পড়বে। ঘরবাড়ি, চাষের জমি জলের তলায় চলে গেলে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে অন্যত্র পাড়ি দেওয়ার সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। আইপিসিসি ইতিমধ্যেই এই বিষয়ে সতর্ক করেছে। পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন অঞ্চলে আয়লা, আমপানের পর সেই প্রবণতা লক্ষণীয়। দুর্ভাগ্য, এই সব ঘটনা থেকে এখনও উপযুক্ত শিক্ষা নেয়নি দেশের বা রাজ্যের সরকার। এই জলবায়ু-শরণার্থীদের নিয়ে সুস্পষ্ট পরিকল্পনা প্রয়োজন। সঙ্গে প্রয়োজন উপকূল রক্ষা আইনকে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া। পর্যটন জরুরি অবশ্যই, কিন্তু অগণিত মানুষের জীবন, জীবিকা রক্ষাও সরকারের দায়িত্ব। কোনও মূল্যেই সেই দায়িত্বে অবহেলা চলবে না।