নুথালাপতি ভেঙ্কট রমণা।
ষোলো মাসের মেয়াদ শেষে অবসর নিলেন ভারতের প্রধান বিচারপতি নুথালাপতি ভেঙ্কট রমণা। তাঁর বিদায়সভায় যে ভঙ্গিতে তাঁর কর্মকালের প্রশংসা হল, তাতেই স্পষ্ট যে, প্রধান বিচারপতি তাঁর দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হননি। তবে, সর্বোচ্চ আদালতের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা বজায় রেখেও এখানে একটি খেদ প্রকাশ না করলেই নয়— অতীত অভিজ্ঞতা এমনই যে, বিচারপতি রমণার জন্য সাফল্যের মাপকাঠিটি তেমন কঠোর ছিল না। তাঁর মেয়াদে তিনি সরকারের প্রতি প্রকট পক্ষপাতিত্ব প্রদর্শন করেননি, তাঁর পূর্বসূরিদের মতো অবাঞ্ছিত বিতর্কে জড়িয়ে পড়েননি। প্রধান বিচারপতি শারদ অরবিন্দ বোবডের আমলে বিশেষত রাজনৈতিক ভাবে তাৎপর্যপূর্ণ মামলা বণ্টন নিয়ে যে যথেচ্ছাচারের অভিযোগ উঠেছিল, বিচারপতি রমণা সেই পথেও হাঁটেননি। পরিস্থিতির বিচারে তাঁর এই সংযম ও নিষ্পক্ষতা প্রশংসনীয়, কোনও সন্দেহ নেই— কিন্তু কেউ প্রশ্ন করতেই পারেন যে, দেশের প্রধান বিচারপতির কাছে যে নিষ্পক্ষতা মৌলিক ভাবে প্রত্যাশিত, তা-ই কি তাঁর কৃতিত্ব হিসাবে বিবেচিত হতে পারে? যদি তা-ই হয়, তবে ভারতীয় গণতন্ত্রের পক্ষে তা সুসংবাদ নয়।
শাসকদের কাছে অস্বস্তিকর হতে পারে, এমন বেশ কয়েকটি মামলা প্রধান বিচারপতি রমণার আমলে গৃহীত হয়েছে। এই কথাটি বিশেষ ভাবে উল্লেখ করতে হচ্ছে, তা দুর্ভাগ্যের কথা— কিন্তু, যে দুর্ভাগ্য বাস্তব, তাকে স্বীকার করাই বিধেয়। বর্তমান কেন্দ্রীয় শাসকদের অতি প্রিয় অস্ত্র রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের আওতায় নতুন গ্রেফতারি বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছেন রমণা। সরকারপক্ষের প্রবল আপত্তি অগ্রাহ্য করেই পেগাসাস মামলা গ্রহণ করেছিলেন তিনি— যদিও সে মামলায় সরকারপক্ষের দৃশ্যত অসহযোগিতার কোনও প্রতিকার হয়নি, এবং শেষ পর্যন্ত সরকারের দোষ অপ্রমাণিতই থাকল। লখিমপুর খেরি কাণ্ডে ইলাহাবাদ হাই কোর্ট কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অজয় মিশ্রের পুত্র আশিসকে জামিন দিয়েছিল; বিচারপতি রমণার নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বেঞ্চ তা নাকচ করে। প্রিভেনশন অব মানি লন্ডারিং অ্যাক্ট নামক আইনটির কিছু বিতর্কিত দিক খতিয়ে দেখতেও সম্মত হয়েছে তাঁর নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ। তাঁর আমলের আরও একটি উল্লেখযোগ্য দিক বিচারব্যবস্থার প্রশাসনিক সংস্কার। বহু নতুন বিচারক নিযুক্ত হয়েছেন। অন্তর্বর্তী আদেশ, স্থগিতাদেশ, জামিনের নির্দেশ ইত্যাদি যাতে দ্রুত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে পৌঁছতে পারে, তার জন্য ইলেকট্রনিক মাধ্যমের ব্যবহার শুরু হয়েছে তাঁরই আমলে।
তবুও কিছু আক্ষেপ থাকে। রমণার মেয়াদকালে একটি মামলাও সাংবিধানিক বেঞ্চে যায়নি। এই ক্ষেত্রে তিনি কার্যত বিচারপতি বোবডের উত্তরাধিকার বহন করেছেন। লক্ষণীয় যে, পরবর্তী প্রধান বিচারপতি উদয় উমেশ ললিতের মাত্র আড়াই মাসের মেয়াদের শুরুতেই ঘোষণা হয়েছে, পঁচিশটি বকেয়া মামলা সাংবিধানিক বেঞ্চে যাবে, এবং সেই বেঞ্চ বছরভর কাজ করবে। বিচারপতি রমণা শীর্ষ পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার আগে থেকেই এমন কিছু অতি গুরুত্বপূর্ণ মামলা আদালতে বকেয়া ছিল, যার প্রতিটিই ভারতীয় গণতন্ত্রের মৌলিক চরিত্রকে বদলে দিতে পারে। ইলেক্টরাল বন্ড থেকে কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা প্রত্যাহার, নাগরিকত্ব আইন সংশোধন থেকে অর্থনৈতিক ভাবে পশ্চাৎপদ শ্রেণির (ইকনমিক্যালি উইকার সেকশন বা ইডব্লিউএস) জন্য সংরক্ষণ, আধার সংশোধনী অধ্যাদেশ থেকে অর্থ বিল বিষয়ক সাংবিধানিক পরীক্ষা— এমন বহু মামলাই ফয়সালাহীন থেকে গেল। ভারতীয় বিচারব্যবস্থা তার বকেয়া মামলার আধিক্যের জন্য কুখ্যাত, কিন্তু এই মামলাগুলির তাৎপর্য হল, এর ফয়সালা না হলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সুবিধা শাসক দলের, স্থিতাবস্থার রাজনীতির। অনেক সাফল্যের মাঝেও এই ব্যর্থতার দাগটি অনপনেয় হয়ে থাকবে।