Manipur Violence

আর নয়

এই মুহূর্তে মণিপুরে যা পরিস্থিতি, তাতে মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিংহের পদত্যাগ ও রাষ্ট্রপতি শাসনের দাবি যাঁরা করছেন, তাঁরা ভুল বলছেন না।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০২৪ ০৭:৫৪
Share:

অশান্ত মণিপুর। —ফাইল চিত্র।

মণিপুর রাজ্যটির সঙ্গে গত দেড় বছর যাবৎ এক আশ্চর্য অন্যায় ঘটে চলেছে, লাগাতার। আঠারো মাসে একটি দিনও বোধ হয় স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেনি এই রাজ্য। তার মধ্যেও গত কয়েক সপ্তাহে পরিস্থিতি যেখানে পৌঁছেছে, তাকে বলা চলে অভূতপূর্ব, অচিন্তনীয়। দেশের মধ্যে প্রথম বার এমন ভাবে ড্রোন হানায় কোনও গোষ্ঠীর উপর আক্রমণ শাণানো হয়েছে। আক্ষরিক অর্থে ছারখার হয়ে যাচ্ছে শত শত পরিবার। ছিন্নভিন্ন, গৃহহারা, দগ্ধ ও ক্ষতবিক্ষত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। মহিলা ও শিশুদের উপর আলাদা ভাবে নির্যাতন চলছে। অথচ কেন্দ্রীয় ও রাজ্য বিজেপি সরকার একাদিক্রমে বলে চলেছে, বহিরাগত শক্তির জন্যই নাকি আইনশৃঙ্খলার এমন অবস্থা। অত্যন্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন এই বক্তব্য। প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী যা-ই বলুন, এই দীর্ঘ ও প্রবল হিংসাকাণ্ডকে নিছক আইনশৃঙ্খলার সমস্যা হিসাবে দেখা অসম্ভব। বহিরাগত শক্তির দুষ্কৃতি বলে দেখাও ভাবের ঘরে চুরি। অনেক বড় এই সামাজিক সঙ্কট, গভীরপ্রোথিত এর উৎস, রাজ্যব্যাপী এর পরিসর। প্রধান দুই প্রতিপক্ষ মেইতেই ও কুকি-জ়ো গোষ্ঠী পরস্পরকে আক্রমণের যুক্তি হিসাবে পরস্পরের প্রতি আগেকার নৃশংসতার ঘটনাবলিকে সমানে ব্যবহার করে চলেছে। স্থানীয় জনজাতি গোষ্ঠীসমূহের এই চাপান-উতোর ও গভীরচারী শত্রুতাকে বহিরাগত উস্কানি দিয়ে ব্যাখ্যা করার মধ্যে বিপথচালিত করা কেবল অন্যায় নয়, বিপজ্জনক। এই সব ছেড়ে এখনই সব পক্ষকে এক সঙ্গে বসিয়ে সমাধানের রাস্তা খুঁজে বার করতে হবে। এবং সে কাজটি নিশ্চিত ভাবেই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের দায়িত্ব। বহু-অবহেলিত দায়িত্ব।

Advertisement

এই দায়িত্ব দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কথা ছিল। ঘটনা হল, মণিপুরের মেইতেই ও কুকি-জ়ো’র মধ্যেকার এই সঙ্কটের গোড়ায় যে সংরক্ষণ ও বিশেষ অর্থনৈতিক সুবিধার প্রশ্নটি আছে, সেটি মাথায় রাখলে বোঝা সহজ যে যদিও সে রাজ্যে সমস্যাটি বিশেষ আগ্নেয় আকার ধারণ করেছে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই সমস্যার একটি ব্যাপকতর চরিত্র আছে। দেশময় বিবিধ ও বিভিন্ন জনজাতি গোষ্ঠীর মধ্যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে এক অবশ্যম্ভাবী কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক বাস্তবের প্রতিফলন ঘটছে মণিপুরের বর্তমান সঙ্কটে। সে দিক দিয়ে এই সঙ্কট ঠিক ভাবে মেটানোর দায়িত্ব প্রশাসনেরই— রাজ্যের, কেন্দ্রেরও। কোনও যুক্তিতে এই দায়িত্ব এড়ানো যায় না। এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতে, এখনও অবধি প্রধানমন্ত্রী যে মণিপুরে এক বারও স্বয়ং যাওয়ার সময় পেলেন না, অথচ দেশের বহু জায়গায় গত দেড় বছরে অসংখ্য নির্বাচনী প্রচার ও সফর করার সময় পেলেন— ভারতীয় নাগরিক সমাজ তার থেকে নিশ্চয়ই কিছু বার্তা পাবে।

এই মুহূর্তে মণিপুরে যা পরিস্থিতি, তাতে মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিংহের পদত্যাগ ও রাষ্ট্রপতি শাসনের দাবি যাঁরা করছেন, তাঁরা ভুল বলছেন না। তাঁর সরকার গত আঠারো মাসে রক্তবন্যা ও নৃশংসতা থামাতে পারেনি, ডাবল ইঞ্জিনের বড়াই-ধন্য কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যের বিজেপি সরকারকে কোনও ভাবে সে কাজে সহায়তা করতে পারেনি। এখন মণিপুরের শাসক সমাজেরই একাংশ আফস্পা নিয়োগের দাবি তুলেছেন, ১৪ নভেম্বর থেকে জিরিবাম-সহ উপত্যকার ছয়টি পুলিশ থানা অঞ্চলে আফস্পা জারি হয়েছে। একে দুর্ভাগ্য বললেও কম বলা হয়, কেননা এই রাজ্যেই অতীতে আফস্পা নিয়ে ঐতিহাসিক প্রতিরোধ আন্দোলন দেখা গিয়েছে। স্পষ্টতই, প্রশাসনের প্রতি জনসমাজের আস্থা এখন একেবারে শূন্য, নিরাপত্তা ও স্বাভাবিক জীবনের আশা সম্পূর্ণ তলানিতে। এই অবস্থা আর বেশি দিন চালানো রাষ্ট্রের তরফেই মানবাধিকার ভঙ্গের নিদর্শন ও ভারতীয় গণতন্ত্রের ভয়ানক ব্যর্থতা বলে গণ্য হবে। যুক্তরাষ্ট্রের জীবনেও এমন অনেক মুহূর্ত আসে, যখন কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপের প্রয়োজন আবশ্যিক হয়ে পড়ে। মণিপুরে সেই মুহূর্ত সমাগত।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement