ফাইল চিত্র।
দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কত, তাহা জানা নাই বলিয়া জানাইয়া দিল কেন্দ্রীয় সরকার। এমন নির্লজ্জ স্বীকারোক্তি ভারতের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় অভূতপূর্ব। অতিমারিতে দারিদ্র বাড়িল কি না, তাহার খোঁজ করিবার প্রয়োজনও বোধ করে নাই দেশের সরকার, জানিয়া দেশ লজ্জিত হইয়াছে। দরিদ্র, বিপন্ন, প্রান্তিক নাগরিকের এমন অবমাননা ইতিহাসে অতুলনীয়। সরকারের এই ঘোষিত অজ্ঞতায় কি এই মনোভাবটিই স্পষ্ট নহে যে, দরিদ্রের সংবাদ না রাখিয়াও প্রশাসন চলিতে পারে; দারিদ্র নিরসনের কৌশল না ভাবিয়াও বাজেট বরাদ্দ হইতে পারে; দারিদ্র কমিল কি না তাহার মূল্যায়ন না করিয়াও সরকার আপন ‘সাফল্য’ প্রচার করিতে পারে? অবশ্য দরিদ্রের সংখ্যা জানিতে ‘অনীহা’র কারণটি আর গোপন নাই— ভারতে দারিদ্র বাড়িয়াছে। সেই বাস্তবটি ‘অচ্ছে দিন’-এর আখ্যানের সহিত খাপ খায় না বলিয়াই কি দরিদ্রের হিসাব অজ্ঞাত থাকিয়া যায়? পরিসংখ্যান বলিতেছে যে, ‘অচ্ছে দিন’-এর যাবতীয় প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও গত সাত বৎসরে সাধারণ মানুষের উন্নয়ন গতিশীল হয় নাই, বরং ব্যাহত হইয়াছে। প্রায় পাঁচ দশক ক্রমান্বয়ে দারিদ্র কমিবার পরে ভারতে দারিদ্র বাড়িয়াছে, দরিদ্রের মোট সংখ্যা বাড়িতেছে। প্রকৃত তথ্য সম্মুখে আসিলে মানব উন্নয়নের নিরিখে ভারতের স্থান হইবে আফ্রিকা এবং পশ্চিম এশিয়ার দরিদ্র দেশগুলির সহিত।
বেগতিক দেখিয়া মাথা কাটিয়া মাথাব্যথার চিকিৎসার ব্যবস্থা হইতেছে। যে সকল তথ্য সরকারকে বিব্রত করিতে পারে, সেগুলি সংগ্রহই না করিলে গোল চুকিয়া যায়। সরকার সংসদে কখনও জানাইয়াছে, ঘরে ফিরিবার সময়ে কত পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যু হইয়াছে, জানা নাই। কখনও বলিয়াছে, কত কোভিড রোগীর অক্সিজেনের অভাবে মৃত্যু হইয়াছে, জানা নাই। সম্প্রতি জানাইল, অতিমারির জন্য কত লোক দারিদ্রে পতিত হইয়াছে, জানা নাই। যদিও অভিযোগ উঠিয়াছে, তথ্য থাকিতেও গোপন করিতেছে সরকার। নাগরিকের ভোগব্যয় সম্পর্কিত জাতীয় নমুনা সমীক্ষার রিপোর্ট (২০১৭-১৮), যাহা দেশবাসীর আয়ের একটি ইঙ্গিত দেয়, তাহা যথাসময়ে প্রস্তুত হইয়াছিল। কেন্দ্রই তাহার তথ্যের মান্যতা লইয়া প্রশ্ন তুলিয়া তাহা প্রকাশিত হইতে দেয় নাই। সংবাদে প্রকাশ, ওই রিপোর্টে দারিদ্রবৃদ্ধির সাক্ষ্য মিলিয়াছে। ইহার ফলে এক দশকেরও অধিক সময় ভারত দরিদ্রের সংখ্যা প্রকাশ করে নাই। তাহার ফলে বিশ্বে দারিদ্রের পরিমাপ করা যায় নাই বলিয়া জানাইয়াছে বিশ্ব ব্যাঙ্ক, কারণ ভারতেই বিশ্বের সর্বাধিক দরিদ্র মানুষ বাস করেন।
স্বভাবতই অভিযোগ উঠিতেছে যে, তথ্য গোপন করিয়া, ভ্রান্ত তথ্য দিয়া, অথবা নীরব থাকিয়া সরকার দারিদ্র নিরসনের দায় এড়াইতে চায়। অগত্যা নাগরিক সমাজই আপন সাধ্যমতো নাগরিকের দারিদ্র, কর্মহীনতা, খাদ্যনিরাপত্তা প্রভৃতি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করিতেছে। আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের রিপোর্ট অনুসারে, লকডাউনে অন্তত ৩৫ কোটি মানুষ দারিদ্রে পতিত হইয়াছেন। এক আমেরিকান গবেষণা সংস্থার তথ্য, অতিমারির এক বৎসরে ভারতে দরিদ্রের সংখ্যা দ্বিগুণ হইয়াছে। অবশ্য অতিমারির পূর্বেই দারিদ্র ও বেকারত্ব বাড়িয়াছিল। নোটবন্দির সিদ্ধান্ত তাহার জন্য কিয়দংশে দায়ী, এই অভিযোগও সরকারকে দারিদ্রের আলোচনা হইতে বিমুখ করিয়াছে। সত্যকে স্বীকার করিবার, কর্তব্য পালন করিবার সৎসাহস কি রাজনীতি হইতে বিদায় লইল? সাফল্যের আস্ফালনই কি নেতার কর্তব্য হইয়া দাঁড়াইয়াছে? এই আত্মঘাতী প্রবঞ্চনার এই বার সমাপ্তি হউক। দারিদ্র বাড়িয়াছে, এই সত্য স্বীকার করিয়া সকল তথ্য প্রকাশ করুক কেন্দ্র। প্রতিকারে আহ্বান করুক দেশের সকল স্তরের, সকল মতের মানুষকে। তাহাই হইবে যথার্থ নেতৃত্বের স্বাক্ষর।