বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার।
সকালবেলার চেহারা দেখে দিনটা কেমন যাবে সে-কথা যে মোটেই নিশ্চিত বলা যায় না, নীতীশ কুমারের কাহিনি তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। ২০০০ সালে নির্বাচনের পরে ত্রিশঙ্কু বিধানসভার সুযোগে জীবনে প্রথম বার মুখ্যমন্ত্রী পদের দাবিদার হয়েছিলেন, কিন্তু আস্থা ভোটের আগেই হাওয়া বুঝে পদত্যাগ করেন। হাওয়া-জ্ঞান তাঁর বরাবরই টনটনে। প্রথম ইনিংসে শূন্য রানের গ্লানি পিছনে ফেলে পাঁচ বছর পরে পটনার তখ্তে তাঁর অধিষ্ঠান। সেই থেকে— ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে দলের বিপর্যয়ের পরে জিতনরাম মাঁঝিকে মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসিয়ে কৌশলী পশ্চাদপসরণের সংক্ষিপ্ত পর্বটুকু বাদ দিলে— তিনি বিহার শাসন করছেন। ২০০৫ ও ২০১০-এ এনডিএ’র শরিক, ২০১৫’য় ‘মহাগঠবন্ধন’-এর, ২০১৭’য় মধ্যপথে রাষ্ট্রীয় জনতা দলের হাত ছেড়ে ফের বিজেপির শিবিরে, ২০২২-এ আবার মাঝরাস্তায় তেজস্বী যাদবের সঙ্গে উল্টোরথে। প্রায় দু’দশক ধরে পাটলিপুত্রে কত বার সমীকরণ পাল্টেছে সেই হিসাব রাখতে চিত্রগুপ্তও নাজেহাল; কিন্তু অঙ্ক যত জটিলই হোক, শেষ ফল এক এবং অদ্বিতীয়: মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার। প্রথম ইনিংসের স্মৃতি দিগন্তে বিলীন।
এমন খেলার প্রতিভাকে পুরনো আয়ারাম-গয়ারামের ছকে বা নতুনতর দল-ভাঙানোর রীতিতে মেলানো যাবে না। নীতীশ কুমার দল বদলান না, অকাতরে অন্য দল ভাঙিয়ে ভাঙিয়ে আপন গোঠের ওজন বাড়ানোর অধুনা-প্রকট মডেলও তাঁর নয়, তিনি নিজেকে এবং নিজের দলটিকে ব্যবহার করে শাসনক্ষমতা ধরে রাখেন। এবং সেটা করেন মসৃণ ভাবে, গত কাল যাঁদের বিরোধী শিবিরে ছিলেন আজ তাঁদের শরিক হয়ে যান বা তাঁদের শরিক করে নেন। হিন্দুত্ববাদী বিজেপি কিংবা জাতপাতের পরিচিতি-নির্ভর রাজনীতিতে প্রতিদ্বন্দ্বী আরজেডি, দুইয়ের পাশেই নীতীশ কুমার স্বচ্ছন্দ। এই মসৃণতা কি অনৈতিকতার নামান্তর? দ্বিচারিতার অভিজ্ঞান? নীতীশ কুমারকে এ-প্রশ্ন করলে তিনি সম্ভবত স্পষ্ট উত্তর দেবেন না, কৌশলে এড়িয়ে যাবেন। তাঁর রাজনীতিতে কোনও দিনই নৈতিক আদর্শের কোনও ভূমিকা দেখা যায়নি। ভারতীয় রাজনীতিতে আদর্শের প্রশ্ন সাধারণ ভাবেই বহুলাংশে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গিয়েছে, কিন্তু দলনেতাদের বাগাড়ম্বরে নীতি এবং আদর্শের কথা বহুলপ্রচারিত, নরেন্দ্র মোদী তার একটি দৃষ্টান্তমাত্র। নীতীশ কুমারের কথাবার্তায়, মানতেই হবে, সেই আড়ম্বরও সচরাচর অনুপস্থিত। নিন্দকরা তাঁর রাজনীতিকে নির্লজ্জ বলতে পারেন। সেই নিন্দাকে অসত্য বলে উড়িয়ে দেওয়া কঠিন। কিন্তু একই সঙ্গে মনে রাখা দরকার যে, নির্লজ্জ এবং অলজ্জ, দু’টি শব্দের অর্থ এক নয়।
প্রশ্ন উঠতে পারে, এমন নিরন্তর শিবির বদলানোর খেলাই যাঁর ধর্ম হয়ে উঠেছে, ক্রমশ কি শরিক হিসাবে তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতার ক্ষয় হবে না? এক স্তরে এ-প্রশ্নের উত্তর সংশয়াতীত— এমন রাজনীতিককে কোনও শরিকই সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতে পারে না। কিন্তু তার পরেও একটি স্তর আছে, সেখানে বিশ্বস্ততা ব্যাপারটাই হয়তো তার গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে। যত ক্ষণ স্বার্থের সঙ্গে স্বার্থ মিলিয়ে ক্ষমতা ধরে রাখা যায় তত ক্ষণই খেলা চলুক, পরিস্থিতি পাল্টালে সেই অনুসারে পথও পাল্টে নেওয়া যাবে। বস্তুত, ভারতীয় রাজনীতি অনেক কাল যাবৎ এমন একটা পরিণতির দিকেই চলেছে। রাজনীতিতে স্থায়ী বন্ধু বা শত্রু বলে কিছু হয় না, কেবল স্থায়ী স্বার্থ হয়, এ-কথা তো সুপ্রাচীন, এখন তারই এক চরম রূপ দেখা যাচ্ছে। এই প্রবণতা কি বদলাতে পারে? নৈতিকতায় সুস্থিত, বিশ্বস্ততায় আস্থাশীল সুরাজনীতির প্রত্যাবর্তন কি ঘটতে পারে? তার উত্তর আছে জনসমাজের হাতে। নাগরিকরা যদি তেমন সুস্থ রাজনীতি ফিরে চান, রাজনীতিকদের অন্য ছবিও দেখা যাবে। তা না হলে নীতীশ কুমাররাই রাজত্ব করবেন।