জানুয়ারির পরে ফেব্রুয়ারি আসে, কুড়ির পরে একুশ। অতএব, বর্ষগণনার দুর্নিবার নিয়মে, আরও এক বার একুশে ফেব্রুয়ারি সমাসন্ন। পশ্চিমবঙ্গের নতুন বাগ্ধারার অনুপ্রেরণায় বলা চলে: দুয়ারে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। আরও এক বার বাঙালির প্রাণ বাঙালির মন শতবীণাবেণুরবে মাতৃভাষার বন্দনায় মুখর হবে, তার সঙ্গে সমান তালে সঙ্গত করবে বাংলার প্রতি এ-কালের বঙ্গসমাজের, বিশেষত সেই সমাজের তরুণ প্রজন্মের অবহেলা ও বিরাগ নিয়ে ক্ষোভ, গ্লানি ও হা-হুতাশ। বন্দনা এবং গঞ্জনা, কোনওটিই অযৌক্তিক নয়। সাত দশক অতিক্রান্ত ইতিহাসের যে অনন্য ভাষা-সংগ্রামের কারণে একুশে ফেব্রুয়ারি চিহ্নিত, তা কেবল বাংলা ভাষার অপরিমেয় গৌরবের সূচক নয়, সেই গৌরব কালক্রমে সারা দুনিয়ার প্রতিটি মানুষের মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধার অভিজ্ঞান হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এমন দিনের বন্দনা কেবল স্বাভাবিক নয়, অবশ্যকর্তব্য। আবার আত্মগ্লানিও অনিবার্য, কারণ পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষা তার প্রাপ্য মর্যাদা উত্তরোত্তর হারিয়ে ফেলছে। সামাজিক পরিসরে, তথাকথিত শিক্ষিত মহলেও, বাংলার চর্চায় দৈন্য ক্রমবর্ধমান; সমাজের এক বড় অংশ শুদ্ধ বাংলা লিখতে, পড়তে, এমনকি বলতে অপারগ। সরকারি নির্দেশিকা থেকে বিবিধ পণ্য ও পরিষেবার বিজ্ঞাপন, রাজনীতির প্রচার-চিত্র থেকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের বিজ্ঞপ্তি, সমস্ত ক্ষেত্রেই পরিচ্ছন্ন, এমনকি নির্ভুল বাংলার ঘোর অনটন। আত্মপ্রশস্তির সঙ্গে সঙ্গে আত্মসমালোচনাও সঙ্গত বইকি।
সমস্যা একটাই। একুশের পরে যথাকালে বাইশে ফেব্রুয়ারি সমাগত হয়। দিন পাল্টানোর সঙ্গে সঙ্গে বন্দনা এবং গঞ্জনা, দুই-ই স্তিমিত হয়, দ্রুত অন্তর্হিতও। পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ভাষা তার উপেক্ষিত অস্তিত্ব নিয়ে পরের বছরের ভাষা দিবসের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। এই ইতিহাস বদলানোর উপায় একটিই। বাংলা ভাষার প্রবল ও কার্যকর চর্চা। কেবল সাহিত্যের পরিসরে বা প্রাতিষ্ঠানিক ভাষা শিক্ষার অলিন্দে নয়, সামাজিক জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহারিক প্রয়োগ ও অনুশীলনের মধ্য দিয়েই সেই চর্চা নতুন গতি ও প্রাণ অর্জন করতে পারে। সেই কাজে সরকারি প্রযত্ন জরুরি, যে প্রযত্নের সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি দীর্ঘদিন ধরেই এই রাজ্যের এক পীড়াদায়ক বাস্তব— সরকারি কাজকর্মে বাংলার সুষ্ঠু ব্যবহার আজও পশ্চিমবঙ্গের স্বাভাবিক রীতি হয়ে উঠতে পারেনি। নেতানেত্রীদের মুখের কথায়, গদ্য-পদ্য রচনায় এবং তর্জনগর্জনে বিচিত্র এক বাংলার দাপট বেড়েছে বটে, কিন্তু তা ভাষার উন্নতি সাধন করেনি, তার আরও ক্ষতি করেছে। বস্তুত, যথেষ্ট শিক্ষা, যত্ন এবং দায়িত্ববোধের অভাব নিয়ে ভাষার স্বাস্থ্য উন্নত করা সম্ভব নয়। বর্তমান শাসকদের তহবিলে তার কোনওটিরই কিছুমাত্র প্রত্যাশা নেই।
প্রত্যাশা যার কাছে থাকার কথা, সেই বিদ্বৎসমাজ? উনিশ শতকের মধ্যপর্ব থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পার হয়েও দ্বিভাষিক বাঙালি মাতৃভাষায় জ্ঞানচর্চার যে ধারাটি সচল রেখেছিলেন, আজও তার কিছু সুফল পাওয়া যায়, বাংলায় জ্ঞানচর্চার স্রোত আজও সম্পূর্ণ স্তব্ধ হয়নি। কিন্তু সেই স্রোতটিকে প্রথমত জোরদার করে তুলতে হলে এবং দ্বিতীয়ত তাকে সমাজের বৃহত্তর পরিসরে প্রসারিত করতে চাইলে কার্যত এক নতুন সামাজিক আন্দোলনের প্রয়োজন। অতীত ইতিহাস থেকে অবশ্যই সেই আন্দোলনের প্রয়োজনীয় প্রেরণা ও রসদ সংগ্রহ করতে হবে, কিন্তু তাকে গড়ে তুলতে হবে বর্তমান বাস্তবের ভিত্তিতেই। তার একটি প্রাথমিক উপায় হতে পারে মাতৃভাষার মাধ্যমে সুশিক্ষার আয়োজন করা। তা নিছক মাতৃভাষায় পাঠ্যবই লেখার প্রশ্ন নয়। প্রথমত, সেই ভাষাকে ছাত্রছাত্রী তথা সাধারণ পাঠকের কাছে বোধগম্য এবং আকর্ষক করে তোলা জরুরি, তা না হলে বাংলা ভাষায় লেখা বই দুর্বোধ্য ও দুষ্পাঠ্য হয়ে উঠতে পারে, তার বহু নিদর্শন চার পাশে ছড়িয়ে আছে। দ্বিতীয়ত, কেবল স্কুলকলেজের নির্ধারিত পাঠ্যবই নয়, প্রয়োজন বিভিন্ন বিষয়ে সুলিখিত বাংলা বই ও পত্রপত্রিকার, প্রয়োজন সেগুলি ছাত্রছাত্রী ও বৃহত্তর পাঠকসমাজের হাতে পৌঁছে দেওয়ার। আপাতবিচারে এমন প্রস্তাবকে কল্পনাবিলাস মনে হতে পারে, কিন্তু ঠিক ভাবে চেষ্টা করলে বই পড়ার আগ্রহ জাগিয়ে তোলার উদ্যোগ সফল হতে পারে, পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় আজও, শিক্ষার এই গভীর সঙ্কটের পরিস্থিতিতেও তার নজির মিলেছে, মিলছে। এমন নজির যদি আরও অনেক তৈরি করা যায়, তবে হয়তো একুশে ফেব্রুয়ারি ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে মুক্তি পাবে।