ছোট ও প্রান্তিক চাষিদের অভাবী বিক্রি এড়াতে কুইন্টাল-পিছু আলুর ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ৯০০ টাকা স্থির করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার, এবং চাষিদের কাছ থেকে ১১ লক্ষ টন আলু কেনার পরিকল্পনা করেছে। গত বারের মতো এ বছরেও রাজ্যের হিমঘরে যে ৮০ লক্ষ টনের মতো আলু মজুতের ব্যবস্থা আছে, তার ৩০% সংরক্ষিত রেখেছে প্রান্তিক ও ছোট চাষিদের জন্য। এতে চাষিদের কতটা লাভ হবে?
উত্তরপ্রদেশের পর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম আলু উৎপাদক রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ। ২০২৪-২৫ সালে আলু চাষ হয়েছে পাঁচ লক্ষ হেক্টর জমিতে, যা আগের বছরের চেয়ে কিছুটা বেশি। ফলনও ১০০ লক্ষ টন থেকে বেড়ে ১৪৫ লক্ষ টন ছাড়িয়েছে। পাশাপাশি বেড়েছে আলু চাষে খরচ। ডিরেক্টরেট অব ইকনমিক্স অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিক্স এ বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য দিয়েছে ২০২১-২২ সালে। সে বছর কেবল চাষের উপাদান, উপকরণের দাম ধরে উৎপাদন খরচ ছিল কুইন্টাল-পিছু প্রায় ৫৪৫ টাকা, আর তার সঙ্গে পারিবারিক শ্রম, জমির ভাড়া প্রভৃতি যোগ করলে মোট খরচ ছিল ৯২১ টাকা। এই হিসাবে এখন নিশ্চিত ভাবেই কুইন্টাল-পিছু আলু উৎপাদনের খরচ ১০০০ টাকা ছাড়িয়েছে। অতএব ৯০০ টাকা কুইন্টাল সহায়ক মূল্য কোনও মতেই যথেষ্ট নয়।
পচনশীল দ্রব্য হওয়ায় চাষি আলু ঘরে রাখেন না। অনেক চাষি মাঠেই আলু বিক্রি করে দেন। আলু ব্যবসায়ী ও ফড়েরা চাষিদের কাছ থেকে সরাসরি আলু কিনে মার্চ-এপ্রিল মাসে হিমঘরে ভরেন। অনেক হিমঘর মালিকও আলু কিনে রাখেন। এর পর ব্যবসায়ী ও হিমঘর মালিক নভেম্বর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে কিছু কিছু করে আলু বাজারে সরবরাহ করেন। এই সময় চাষির হাতে আলু না থাকায় বাজারে আলুর দাম কিছুটা বেশি থাকে। অন্য রাজ্যে পাঠানোর পাশাপাশি বাজারে কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করেও ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে লাভ তোলেন।
গত বছর বৃষ্টিপাতের কারণে আলুচাষে ফলন কম হয়, ফলে বাজারে আলুর দাম বেড়ে যায়। ২০২৪-এর এপ্রিল-মে মাসে খুচরো বাজারে জ্যোতি আলুর দাম ছিল কেজি প্রতি ৩০ টাকার আশেপাশে। প্রশাসন আলুর দাম কমানোর জন্য নানা ভাবে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। চাষের সমস্ত ঝুঁকির বিনিময়ে চাষিরা যে লাভ পেয়েছিলেন, তার থেকে অনেক বেশি লাভ তুলেছিলেন ব্যবসায়ী ও ফড়েরা। বাজারে কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করা হয়েছিল। যার প্রমাণ, এ বছর এখনও পর্যন্ত গত বছরের প্রায় ১.৩ লক্ষ বস্তা আলু হিমঘরে রয়ে গিয়েছে।
মনে হতে পারে, এতে তো ব্যবসায়ীদের ক্ষতি। প্রকৃতপক্ষে এই পরিমাণ আলুর জন্য ব্যবসায়ীদের যে ক্ষতি হয়েছে, তার থেকে অনেক বেশি লাভ আগেই তোলা হয়ে গিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, সরকার ভিন রাজ্যে আলু পাঠানোয় নিষেধাজ্ঞা জারি করলে ব্যবসায়ী সংগঠন তাতে প্রতিবাদ জানায়, ও সরকারকে আলু কিনতে অনুরোধ করে। চাষির হয়ে কুমিরের কান্না কাঁদে।
এ বছর হুগলি, পূর্ব বর্ধমান প্রভৃতি জেলার চাষিরা সাড়ে পাঁচ টাকা থেকে সাড়ে সাত টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। তবু যে অনেকেই সরকারকে আলু বিক্রিতে উৎসাহিত হচ্ছেন না, তার কারণ চাষির কাছ থেকে আলু কেনার নানা শর্ত আরোপ করা হয়েছে। চাষিকে আলু বিক্রি করতে হলে তিনি যে প্রান্তিক বা ছোট চাষি, তার প্রমাণস্বরূপ বিডিও-র কাছ থেকে সার্টিফিকেট নিতে হবে। সেটা সাধারণ চাষির পক্ষে কঠিন। যাঁরা জমি ঠিকা নিয়ে চাষ করেন, তাঁরা তো এটা কোনও ভাবেই প্রমাণ করতে পারবেন না। তার পর রয়েছে আলু বস্তায় ভরা, ট্রাক্টরে চাপানো, হিমঘরে নিয়ে যাওয়া, এবং সেখানে গাড়ি থেকে বস্তা নামানোর খরচ, যা চাষিকেই দিতে হয়। তারও আগে আলু বাছাই করতে হবে— সরকার কেবল ৯৫ গ্রামের বেশি ওজনের আলু নেবে। এবং প্রতি চাষির কাছ থেকে সর্বাধিক ৭০ বস্তা আলু কিনবে। এত সামান্য আলু বিক্রির জন্য এতটা ঝঞ্ঝাট চাষি নিতে চান না।
সর্বোপরি, সরকার সহায়ক মূল্যে আলু কেনার কথা ঘোষণা করলেও, কবে থেকে কেনা হবে সে বিষয়ে চাষিদের মধ্যে সে ভাবে প্রচার করা হয়নি। হিমঘরে আলু রাখা শুরু হয়ে গিয়েছে। আরও দেরি করলে সরকারি সহায়ক মূল্য চাষিরা নন, পাবেন ব্যবসায়ীরা।
উল্লেখ্য যে, কেন্দ্রীয় সরকারের মূল্য নির্ধারণ কমিটি আলুকে সহায়ক মূল্য দেওয়ার ফসলের তালিকা থেকে বাদ রাখলেও রাজ্য সরকার আলুতে সহায়ক মূল্য ঘোষণা করেছে। সরাসরি আলু কিনতে চেয়ে চাষির ক্ষতির পরিমাণ কিছুটা কমানোর চেষ্টা করেছে। এতে রাজনীতির গন্ধও আছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার ২০২১ সালেও বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক আগে আলুর অধিক ফলনের জন্য সহায়ক মূল্য স্থির করেছিল, এবং চাষিদের কাছ থেকে ১৬ লক্ষ টন আলু কিনেছিল। এর পর আর সহায়ক মূল্যে আলু কেনা হয়নি। ২০২৬ সালে আবারও রয়েছে বিধানসভা ভোট। তার ঠিক আগেই এল সহায়ক মূল্যে সরকারের আলু কেনার ঘোষণার কথা।
প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর
সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ
সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে