আরও একটি স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপনের মুখে, সম্প্রতি সামনে এল ‘সাফাই কর্মচারী আন্দোলন’ (এসকেএ) নাগরিক গোষ্ঠীর হৃদয়বিদারী তথ্য: এ বছর ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাইয়ের মধ্যে ভারতে মোট ৪৩ জন ‘সাফাইকর্মী’ মারা গিয়েছেন— ম্যানহোল ও সেপটিক ট্যাঙ্ক পরিষ্কার করতে গিয়ে, বিষাক্ত গ্যাসের কবলে। অথচ স্বাধীন সার্বভৌম ভারতরাষ্ট্রে খাতায় কলমে আইনে মানুষকে দিয়ে এ কাজ অর্থাৎ ‘ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং’ করানো নিষিদ্ধ— আজ নয়, ১৯৯৩ সাল থেকে। ২০১৩ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের গালভরা ‘প্রহিবিশন অব এমপ্লয়মেন্ট অ্যাজ় ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জারস অ্যান্ড দেয়ার রিহ্যাবিলিটেশন অ্যাক্ট’ চালু হয়েছে, সে বছরেই এবং পরে ২০১৮-তে সরকারের দু’টি সমীক্ষায় দেশ জুড়ে ৫৮,০৯৮ জন এমন সাফাইকর্মী চিহ্নিতও হয়েছিলেন, তা সত্ত্বেও ২০২১ সালে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রামদাস আঠওয়ালে ঘোষণা করেছিলেন, উপরে বলা আইন মতে দেশে কোনও ‘ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জার’ নেই! আর রাষ্ট্রের কাছে যাঁদের অস্তিত্বই নেই, তাঁরা মরবেনই বা কী করে! সুতরাং এ বছরের তথ্য প্রসঙ্গে কেন্দ্র চুপ।
সরকারই আইন করে, সেই আইনের কোথায় ফাঁক রাখলে পরে কার্যসিদ্ধি করেও নিজেদের গা বাঁচানো যায় সে পন্থাও তাদের বিলক্ষণ জানা। আইনে বলা আছে ‘ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং’-এর সংজ্ঞা: মানুষের বিষ্ঠা ও শরীরী বর্জ্য যখন মানুষই নিজের হাতে কোনও অস্বাস্থ্যকর শৌচালয় বা নর্দমায় নেমে পরিষ্কার করে, বহন করে বা অন্যত্র ফেলে দিয়ে আসে। যে মানুষটি এ সব পরিষ্কার করতে নামছেন তাঁকে বিষাক্ত গ্যাস জীবাণু ইত্যাদি থেকে বাঁচাতে আত্মরক্ষার সামগ্রী দিতেই হবে, এবং আইনের ফাঁকটি লুকিয়ে সেখানেই— এই সামগ্রী ব্যবহার করলেই তাঁকে আর ‘ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জার’ বলা না-ও যেতে পারে। ভারতে এই মানব-বর্জ্য সাফাইকর্মীদের নিয়ে নানা সময়ে হওয়া প্রত্যেকটি খবরে উঠে এসেছে, কাজ করতে গেলে এঁদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় শুধু একটি ঝুড়ি ও একটি রুমাল। মৃত্যুর ঘটনা ঘটলে প্রশাসন দেখায় আত্মরক্ষার সব কিছু এই কর্মীদের সঙ্গেই ছিল, যা ঘটেছে তা নেহাতই দুর্ভাগ্যজনক। বছরের পর বছর এ জিনিস চলে আসছে।
তবু কেন এই মানুষেরা এ কাজ করে চলেন? কারণ, এঁদের আর কোনও কাজ করার সংস্থান করেনি সরকার। ২০১৩-র আইনে ‘রিহ্যাবিলিটেশন’ বা পুনর্বাসনের যে প্রসঙ্গটি আছে তা একেবারেই ব্যর্থ। এই ব্যর্থতার কারণ সন্ধান করতে গেলে বেরিয়ে পড়বে এই ভারতে জাতপাতের বিষ— মানব-বর্জ্য সাফাইকর্মীরা সকলেই সমাজের নিম্নবর্গীয় মানুষ, পুরুষানুক্রমে ও প্রজন্মান্তরে এই কাজ করে চলেছেন। ভারতের সমাজ তাঁদের এ থেকে বিরত তো করেইনি, বরং এক প্রকার নিয়তিবাদী বাধ্যবাধকতা চাপিয়ে দিয়েছে; আর রাষ্ট্র উপর-উপর গালভরা আইন করলেও এঁদের শরীরী অস্তিত্বটুকুও অস্বীকার করে চলেছে। সামাজিক মর্যাদা নেই, কাজে নিরাপত্তা নেই, অর্থ যৎকিঞ্চিৎ, বিকল্প কর্মসংস্থান শূন্য। নাগরিক তথা কর্মীর অধিকারের কথা বাদই থাকুক, স্রেফ মানবিকতার কতটা অপমান ও অমর্যাদা করলে তবে কোনও সভ্য দেশে এখনও মানুষকে দিয়ে এ কাজ করিয়ে নেওয়া চলে, সেই প্রশ্নটি করা দরকার এখনই, এই মুহূর্তে। স্বাধীনতার বুক-বাজানো কুৎসিত পূতিগন্ধময় উদ্যাপনে যেন তা ঢাকা না পড়ে।