একটিমাত্র ঈ-প্রত্যয় যোগে ‘প্রদর্শন’ শব্দটি হইয়া উঠে ‘প্রদর্শনী’। প্রদর্শনীর ভঙ্গিটি নিবেদনের, অন্তত আপাত দৃষ্টিতে। সেই অর্থে অলিম্পিক গেমস হইল ‘বিশ্বের শ্রেষ্ঠ প্রদর্শনী’। কিন্তু টোকিয়োতে যে ভাবে চারটি ফুটবল দলের খেলোয়াড়েরা হাঁটু মুড়িয়া বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাইলেন, অস্ট্রেলিয়া-নিউ জ়িল্যান্ডের অ্যাথলিটরা ইউনিয়ন জ্যাকের সহিত জনজাতির পতাকা উড়াইলেন, বিবিধ মহিলা দল উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পূর্বে লিঙ্গবৈষম্যের প্রতি ধিক্কার বর্ষণ করিলেন, তাহাতে উহা শুধু ক্রীড়াপ্রদর্শনী রহিল না। প্রতিটি উদ্যোগই এক-একটি বলিষ্ঠ মন্তব্যের প্রকাশ— প্রদর্শন। বস্তুত বিশ্বের প্রাচীনতম এই ক্রীড়ানুষ্ঠানকে সমাজ-সম্পৃক্ত বলিলেও ন্যূনোক্তি হইবে, সমাজ-রাজনীতি উহার অপরিহার্য অঙ্গ। এবং, উহা যেমন সামান্য জনতার প্রতিবাদ জানাইবার মঞ্চ, তেমনই সর্বশক্তিমান শাসকের মহিমা দেখাইবার সুযোগও বটে।
প্রসঙ্গত মনে পড়িতে পারে, নাৎসি জার্মানি আয়োজিত ১৯৩৬ বার্লিন অলিম্পিক্স। উহা ছিল আর্যরক্তের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের সোপান। এক জনও অ-জার্মান (অর্থাৎ ইহুদি) ক্রীড়াবিদ দলে ঠাঁই পান নাই, দেশের জয়ী ক্রীড়াবিদ পদক পাইবার সময় নাৎসি রীতিতে দক্ষিণ হস্ত প্রসারিত করিয়া তাঁহাদের অভিবাদন জানাইতেন দর্শকগণ, আর্যসভ্যতার অগ্রদূত হিসাবে গ্রিস হইতে মশাল বহনের ঐতিহ্য চালু করিয়াছিলেন হিটলার। ইহার পর, ঠান্ডা যুদ্ধের কালে পূর্ব-পশ্চিমে নানা দেশের জয়-পরাজয় ক্রীড়াক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকিত না, তাহাকে মুক্ত বিশ্ব বনাম কমিউনিস্টদের সংগ্রামের নিক্তিতে মাপা হইত। স্মরণীয়, পূর্ববর্তী বৎসরে সোভিয়েট ইউনিয়ন কর্তৃক আফগানিস্তান দখল হইবার কারণে মস্কো অলিম্পিক্স বয়কট করিয়াছিল আমেরিকা। উহার জবাবে চার বৎসর পর লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিক্সে দল পাঠায় নাই সোভিয়েট। আবার, একুশ শতকে উন্নয়নশীল দেশগুলির অর্থনৈতিক উন্নতি যখন স্বীকৃতি পাইল, তখন অলিম্পিক্স আয়োজনেরও দায়িত্ব পাইল চিন, রাশিয়া, ব্রাজিল। সেই সূত্রেই এক ধারাবাহিকতা হইল টোকিয়ো।
ক্রীড়ার উপর রাজনীতির প্রভাব অবশ্যম্ভাবী, বিশেষত যখন তাহা বিনোদন বাণিজ্য তথা অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। কিন্তু প্রভাব আর নিয়ন্ত্রণ এক কথা নহে। রাজনৈতিক ছকে ক্রীড়ানুষ্ঠান পরিচালিত হইলে— আধুনিক অলিম্পিক্সে যাহা বারংবার হইয়াছে— তাহা নিন্দার্হ। খেলোয়াড়দের রাজনীতির ব্যবহার্য ‘ঘুঁটি’র সহিত তুলনা করিয়াছিলেন মস্কো অলিম্পিক্সে যোগদান করিতে না-পারা আমেরিকান হেপ্টাথলিট জেন ফ্রেডরিক। লক্ষণীয়, বিগত দেড় দশকে চিন অভূতপূর্ব সংখ্যায় পদক জিতিলেও সেই দেশ হইতে বিশ্বখ্যাত খেলোয়াড়দিগের নাম বহুশ্রুত নয়। ক্রীড়ামহলে শোনা যায়, তাহারা এক অমানুষিক পরিবেশে ক্রীড়াবিদ ‘উৎপাদন’ করিয়া থাকে, অতএব পরিশেষে সকলই রাষ্ট্রের কৃতিত্ব, ব্যক্তি নিমিত্তমাত্র। ভারতেও, নরেন্দ্র মোদীর জমানায়, বিভিন্ন ক্রীড়ায় উৎসাহদান এবং তৎপরবর্তী কালে নানা ক্রীড়াবিদকে শাসক দলের মঞ্চে উপস্থিত করাইবার নূতন প্রবণতায় চিনসদৃশ ছক খুঁজিয়া পাওয়া অমূলক নহে। ২০২০ অলিম্পিক্সের স্থান ঘোষিত হইবার পর জাপানি উদ্যাপনের মূল সুরটি ছিল জাতির পুনরুজ্জীবনের, ক্রীড়ার অগ্রগতির নহে। প্রদর্শন আর প্রদর্শনীর হিসাবটি, অতএব, বুঝিয়া লইতেই হয়।