পূর্ণ নহে, অংশত রেহাই মিলিল অম্বিকেশ মহাপাত্রের। ২০১২ সালে ইমেলে ব্যঙ্গচিত্র পাঠানোর জেরে তাঁহার বিরুদ্ধে তৃণমূলের এক কর্মীর এফআইআর, পুলিশের গ্রেফতার ও পরে মামলা, প্রায় এক দশক সময়ের সহিত বিতর্ক ও রাজনীতির জলও কম গড়ায় নাই। তবু মামলার এখনও নিষ্পত্তি হইল না। পুলিশ চার্জশিটে অনেকগুলি ধারার ভিত্তিতে অভিযোগ করিয়াছিল, সম্প্রতি আদালত একটি অভিযোগ হইতে তাঁহাকে অব্যাহতি দিয়াছে, কারণ সুপ্রিম কোর্টের রায়ে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৬এ ধারাটিই ২০১৫ সালে বাতিল হইয়াছে। মানহানি ও কটূক্তির অভিযোগ প্রযোজ্য কি না, অন্য দুই ধারায় আনীত অভিযোগের শুনানি এখনও বাকি। সুতরাং, নিষ্কৃতিও।
এই সমস্তই একটি ব্যঙ্গচিত্রের জন্য। তাহাতে বিখ্যাত চলচ্চিত্রের অনুষঙ্গ-ব্যবহারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তৃণমূলের দুই নেতার প্রতি বিদ্রুপ নিহিত ছিল। জনপরিসরে, সমাজমাধ্যমে এহেন ব্যঙ্গচিত্র হাস্য ও তর্ক দুইয়েরই উদ্রেক করে, পক্ষ-বিপক্ষ, সমর্থনের প্রাবল্য ও বিরোধের বাহুল্য সবই দৃষ্ট হয়, কিন্তু তাহাতে মূলের কথাটি মিথ্যা হইয়া যায় না: ব্যঙ্গাত্মক হউক কিংবা অন্যতর, ইহা ব্যক্তিবিশেষের মত, এবং সেই মত প্রকাশের স্বাধীনতা ভারতে আছে, ভারতের সংবিধানই সেই স্বাধীনতা তথা অধিকার নিশ্চিত করিয়াছে। এই স্বাধীনতা অবিসংবাদিত, এই অধিকার প্রশ্নাতীত। কে কাহাকে ইমেলে একটি কার্টুন পাঠাইলেন, রাজনীতির বড়কর্তারা সেই কার্টুনের চরিত্র বলিয়াই যদি তাঁহার বিরুদ্ধে এফআইআর হয়, পুলিশ আসিয়া গ্রেফতার করে, মামলা হয় এবং এক দশক ধরিয়া চলিতেই থাকে, তাহা আর যাহাই হউক, সুষ্ঠু প্রশাসনের লক্ষণ নহে, গণতান্ত্রিক তো নহেই। প্রশাসককে বুঝিতে হয়, ব্যঙ্গচিত্র হইতে বিদ্রুপ-ইঙ্গিত সরাইয়া হাসিটুকু ছাঁকিয়া লইলেই চলে। সভায় সারের দাম বৃদ্ধি বা শাসক দলের জনপ্রতিনিধিদের আচরণ লইয়া প্রশ্ন উঠিলে তাহার সদুত্তর দেওয়াই যায়, এমনকি উত্তর না দিলেও চলে, কিন্তু প্রশ্নকর্তাকে মাওবাদী বা বিরোধী দলের ক্যাডার দাগাইয়া দিলে প্রশাসনিক প্রধানের রসবোধ ও বিবেচনাবোধ, দুই লইয়াই ধন্দ জাগে। সর্বোপরি সেই বাক্স্বাধীনতার প্রশ্ন। জননেতার আচরণ বা সিদ্ধান্ত লইয়া নাগরিকের প্রশ্ন বা মতামত— অপ্রিয় বা বিদ্রুপাত্মক হইলেও— সর্বদা গ্রাহ্য, তাহার অস্বীকৃতি সংবিধানেরই অপলাপ।
কেন্দ্রে বিজেপি সরকারের শাসনামলে ইদানীং বাক্স্বাধীনতা লঙ্ঘনের ভূরি ভূরি অভিযোগ। তৃণমূল কংগ্রেস-সহ বহু বিরোধী দলই এই সাংবিধানিক অধিকার ভূলুণ্ঠনের বিরুদ্ধে সরব, এবং সন্দেহ নাই, সেই সরবতা সর্বতো ভাবে ন্যায্য। কিন্তু কেন্দ্রের বাক্স্বাধীনতা হরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী যে দল, তাহার নিজের রাজ্যে তাহারই বিরুদ্ধে একই অভিযোগের ভূত তাড়া করিলে মুশকিল। রাষ্ট্রীয় স্তরে নাগরিক কণ্ঠরোধের যত কুনজির, পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রতিক কালে তাহা নাই। এখানে শাসক দল পুরাতন অভিযোগের বোঝা নামাইয়া, অতীত-আচরণ হইতে শিক্ষা লইয়া সামনের পথ হাঁটিতেছে, বিশ্বাস করিতে ইচ্ছা হয়। তবু নয় বৎসরাধিক কাল প্রলম্বিত অম্বিকেশ-মামলা, ব্যঙ্গচিত্রের জেরে তাঁহার বিরুদ্ধে মানহানি বা কটূক্তির পুলিশি অভিযোগ চিন্তার বিষয়। স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার নিজের ঘরে রক্ষিত হইলে বাহিরের আন্দোলনে শক্তি ও গতি আসিবে। ভিতর হইতেই।