কে কে বেণুগোপাল।—ছবি সংগৃহীত।
কে কে বেণুগোপাল বিজেপি সরকারের অ্যাটর্নি জেনারেল হইয়াও বিজেপি-বিরোধীদের কাছ হইতে একটি ধন্যবাদ দাবি করিতে পারেন। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের একটি সযত্নলালিত গোপনচর্চিত নীতি ও রীতিকে তিনি খানিকটা আকস্মিক ভাবেই মুক্ত আকাশের তলায় লইয়া আসিয়াছেন। এই বার এই নীতি লইয়া খোলাখুলি কথা বলা সম্ভব। সরকারের অ্যাটর্নি জেনারেল বেণুগোপাল দাবি করিয়াছেন যে এক মাস আগে সংবাদমাধ্যমে রাফাল বিমান ক্রয় বিষয়ক যে নথি প্রকাশিত হইয়াছে, তাহা সরকারি গোপন নথি, এবং তাহা ‘চুরি’ করা হইয়াছে। অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট (ওএসএ) দর্শাইয়া বেণুগোপাল যুক্তি দিয়াছেন, এই নথি যাঁহারা চুরি করিয়াছেন, তাঁহাদের শাস্তি প্রাপ্য। সুপ্রিম কোর্টে দাঁড়াইয়া এমন একটি যুক্তি পেশ করিয়া অ্যাটর্নি জেনারেল বুঝাইয়া দিলেন যে সরকারি স্বার্থ আর দেশের স্বার্থ দুইটি আলাদা বিষয়, এবং সরকারি কৌঁসুলি হিসাবে তিনি সরকারের স্বার্থই রক্ষা করিতেছেন, দেশের স্বার্থ নহে। সাধারণ ভাবে নরেন্দ্র মোদী সরকারের কার্যকলাপ বিষয়ে, এবং বিশেষ ভাবে মোদী সরকারের রাফাল বিমান চুক্তি বিষয়ে এই একটি অভিযোগ রাহুল গাঁধী সমেত তাবৎ বিরোধীরা বার বার করিতে চাহিতেছেন। বেণুগোপাল বিরোধীদের সেই অভিযোগটিই তাঁহার নিজস্ব যুক্তিধারা দিয়া পরোক্ষে প্রমাণ করিয়া দিলেন বলিয়া তিনি বিরোধীদের ধন্যবাদার্হ। তিনি এবং তাঁহার সরকার নিশ্চয়ই এই কথা অবহিত আছেন যে যদিও আইন হিসাবে ওএসএ অস্তিত্বশীল, তবু আর একটি গুরুত্বপূর্ণ আইন— রাইট টু ইনফর্মেশন (আরটিআই) অ্যাক্ট-এর সহিত ওএসএ-র সরাসরি বিরোধ আছে, এবং বিরোধ উপস্থিত হইলে গণতন্ত্র কিন্তু দ্বিতীয়টিকেই প্রথমটির উপর রাখিতে চাহিবে। পশ্চিমি গণতান্ত্রিক বিশ্বেও এই বিষয়ে অনেক তর্কবিতর্ক হইয়া গিয়াছে, এবং নাগরিকের তথ্য জানিবার অধিকারের পরিধিটি যে অবহেলার বস্তু নয়, তাহাও স্বীকৃত হইয়াছে।
কেবল তথ্য জানিবার অধিকারই ওএসএ-র বিপক্ষে একমাত্র যুক্তি নয়। সরকার কোন ক্ষেত্রে গোপনীয়তার সুযোগ লয় এবং কোন ক্ষেত্রে গোপন তথ্য উদ্ধারের ‘সাফল্য’কে কাজে লাগায়— তাহাও একটি বড় প্রশ্ন। অবহিত নাগরিক মনে করিতে পারিবেন, ২০১৬ সালে পানামা পেপার্স বাহিরে আসিবার ফলে সরকারের পক্ষে বিপুল হিসাববহির্ভূত সম্পদের সন্ধান পাওয়া সম্ভব হইয়াছে। কথাটি তবে কী দাঁড়ায়? দাঁড়ায় এই যে: যখন নথিপত্র সরকারের পক্ষে যাইবার কথা, তাহার গোপনীয়তার মূল্য নাই। আর যখন নথি প্রকাশ্যে আসিলে সরকারের বিপদের সম্ভাবনা, তখন তথ্য গোপন রাখা মহান কর্তব্য। এই দ্বিচারিতা, এবং তাহার পিছনের অসততার রূপটি যে ভয়ানক, সরকার তাহা বুঝিতেছে কি? বুঝিয়াও যদি এই পদক্ষেপ করা হয়, তবে প্রশ্ন উঠিবেই: দুর্নীতির অভিযোগকে গোপনীয়তার আইনের তলায় চাপা দিয়া রাখাই তবে এই সরকারের উদ্দেশ্য?
বাস্তবিক, সরকারি দুর্নীতির যে কোনও অভিযোগের ক্ষেত্রেই নথিপত্রের স্বাধীনতাকে অনেকখানি মুক্ত পরিসর দেওয়া উচিত। না হইলে, সর্বোচ্চ আদালত ঠিকই বলিয়াছে, অন্যায়কারীকে আশ্রয় ও প্রশ্রয় দিবার বন্দোবস্ত করা হয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এমন কোনও পরিস্থিতির অভিমুখে যাত্রা আইনের লক্ষ্য হইতে পারে না। বেণুগোপাল সম্ভবত অনবধানেই একটি বিষম গুরুতর বিষয়কে বিচারালয়ের সামনে উঠাইয়া ফেলিয়াছেন। আশা থাকিল, আগেও যেমন ঘটিয়াছে, এই বারেও গণতন্ত্রের সতর্ক প্রহরী সুপ্রিম কোর্ট গণতান্ত্রিক মুক্ত পরিবেশের পক্ষেই মত দিবে। অন্তত দুর্নীতির প্রশ্নে, সরকারের বিপরীতে নাগরিক অধিকারের উপরই সমর্থনের সিলমোহর পড়িবে।