গ্রাফিক
কথা হচ্ছিল মুর্শিদাবাদের অজ পাড়াগাঁ থেকে কাজ করতে আসা রাজমিস্ত্রিদের সঙ্গে। তাঁরা হঠাৎ সবাই মিলে প্রশ্ন করতে শুরু করলেন একটা বিষয়ে। না, দুটো বিষয়ে। এক, পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি হলে সত্যিই বৈধ কাগজপত্র থাকা মুসলমান নাগরিকদের এবং অবৈধ ভাবে আসা হিন্দুদের তাড়িয়ে দেওয়া হবে কি না। দুই, ডিটেনশন ক্যাম্পে ক’দিন তাঁদের রাখা হতে পারে এবং শেষ পর্যন্ত ওই ‘রাষ্ট্রহীন অনাগরিক’দের ঠিক কী হবে? শিক্ষার আলোকবঞ্চিত মানুষগুলোর তথাকথিত ডিটেনশন ক্যাম্প সম্পর্কে ধারণা ও সচেতনতা নিয়ে এ বার আমার অবাক হওয়ার পালা। বুঝলাম, ডিটেনশন ক্যাম্পের বাংলা তর্জমা করলে ঠিক কী দাঁড়ায়, সেটাও তাঁরা জানেন না। কিন্তু ধরেই নিয়েছেন যে, রাষ্ট্র এক সময় তাঁদের জেলের থেকেও অনেক ভয়ঙ্কর ওই জায়গাটায় হয়তো পাঠাবেই, তার পর তাঁদের ঠাঁই হবে না কোনও দেশে।
‘ডিটেনশন ক্যাম্প’-এর আক্ষরিক অর্থ ‘আটক শিবির’। আর একটু স্পষ্ট করে বললে, বৈধ নথিহীন অনুপ্রবেশকারী, সন্দেহভাজন বা ঘোষিত বিদেশিদের আলাদা ভাবে আটক করে রাখার জায়গার নাম ‘ডিটেনশন ক্যাম্প’। পরের প্রশ্ন হতে পারে যে, এখানে কে কাকে কোন যুক্তিতে আটক রাখতে পারে? জাতিরাষ্ট্রগুলো আসলে নিজেদের ভৌগোলিক সীমানা, সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা রক্ষার জন্য এই ধরনের আটক শিবির তৈরির যুক্তি খাড়া করে। বর্তমান বিশ্বে অন্তত ১৩০টি দেশে এক হাজারেরও বেশি ডিটেনশন ক্যাম্প আছে।
আজ থেকে এক বছর আগে, আমাদের দেশের শিক্ষিত নাগরিকরা নাৎসি জার্মানির কনসেনট্রেশন ক্যাম্প সম্পর্কে অবহিত হলেও, ভারতীয় গণতান্ত্রিক কাঠামোয় সংবিধান ও আদালতের মাঝামাঝি অবস্থানে থাকা এই ডিটেনশন ক্যাম্পের অস্তিত্ব সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানতেন না। অথচ আজ মুর্শিদাবাদের মিস্ত্রিদের মনেও এটাই সবচেয়ে বড় জায়গা জুড়ে আছে। অসম ছাড়া, রাজধানী দিল্লি-সহ বিভিন্ন রাজ্যে অন্তত ১০টি সচল ডিটেনশন ক্যাম্প আছে। সম্ভবত ২০০৫ সাল থেকে দিল্লিতে অবৈধ অভিবাসী বা অনুপ্রবেশকারীদের আটকে রাখতে ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরি শুরু হয়— যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য, ওল্ড দিল্লি সেবা কুটির, আলিপুর রোড ডিটেনশন হাউস, লামপুর ও দরিয়াগঞ্জের ডিটেনশন সেন্টার। ২০০৫ সালে পশ্চিমবঙ্গে ‘আনডকুমেন্টেড মাইগ্রেন্টস’ বা নথিবিহীন অনুপ্রবেশকারীদের জন্য তৈরি হয় ডিটেনশন সেন্টার বর্ডার সিকিয়োরিটি ফোর্স ক্যাম্প। বিহার ও গুজরাতেও ডিটেনশন সেন্টার আছে। তা হলে? অসমের ডিটেনশন ক্যাম্প নিয়ে হঠাৎ এত আতঙ্ক কেন?
সম্ভবত এর মূল কারণ ডিটেনশন ক্যাম্পে থাকা মানুষগুলোর মনুষ্যেতর জীবনযাপন ও অসহায় মৃত্যুর সংবাদ। সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমের একাংশের বিরুদ্ধে এই বিষয়ে দায়িত্বজ্ঞানহীন সংবাদ প্রকাশের অভিযোগ তুলেছেন সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ। তাঁর অভিযোগ, যে হেতু এনআরসি আসলে ‘ভবিষ্যতের ভিত্তি— বর্তমানের কোনও নথি নয়’, তাই এমন খবর প্রকাশে আরও বেশি করে এনআরসি-জনিত আশঙ্কা ও আতঙ্কের পরিস্থিতি তৈরি করেছে। অথচ খতিয়ে দেখলে বোঝা যায় যে, এনআরসি তালিকা বেরোনোর পর থেকে এই বিশাল সংখ্যক রাষ্ট্রহীনদের নিয়ে ঠিক কী করতে চায় রাষ্ট্র, সেটা জানা বা বোঝা যাচ্ছে না বলেই এতখানি আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। প্রথমে কথা হয় ছ’বছর আটক রাখার। পরে হর্ষ মন্দারের মতো শীর্ষস্থানীয় আইনজ্ঞ ও মানবাধিকার কর্মীদের দাবির ভিত্তিতেই অসমে ডিটেনশন ক্যাম্পে আটক রাখার মেয়াদ কমিয়ে তিন বছর করা হয়েছে।
অসমে দশটি জেলখানাকে ডিটেনশন ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে সম্প্রতি সবচেয়ে আলোচিত গোয়ালপাড়া জেলার মাটিয়ায় প্রায় কুড়ি হাজার একর জমির উপর নির্মীয়মাণ ডিটেনশন ক্যাম্পটি। সেখানে একসঙ্গে অন্তত ৩,০০০ অবৈধ অনুপ্রবেশকারী থাকতে পারবেন। এই ক্যাম্প তৈরির জন্য দিনরাত যে ৪৫০-৫০০ কর্মী কাজ করেছেন, শেষ এনআরসি লিস্টে তাঁদের অধিকাংশেরই নাম ওঠেনি! হয়তো নিজেদের পরিশ্রমে তৈরি এই আটক শিবিরই শেষ পর্যন্ত তাঁদের ঠিকানা হতে চলেছে।
অসমে তথাকথিত ডিটেনশন ক্যাম্পে থাকাকালীন ঠিক কত জন অসুস্থ হয়ে পড়েছেন সেই সংখ্যা কারও জানা নেই। সরকারি রিপোর্ট অনুসারে ২০১১ সাল থেকে এই ক্যাম্পগুলোর অধিবাসীদের মধ্যে এখনও পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ২৭। তার মধ্যে তিনটি মৃত্যু নাড়া দিয়েছে গোটা দেশকে। তাঁরা কারা? সবচেয়ে আলোচিত মৃতের নাম দুলালচন্দ্র পাল, ৬৫ বছর বয়স, তেজপুরের বাসিন্দা। ১৩ অক্টোবর গুয়াহাটি মেডিক্যাল কলেজে তাঁর মৃত্যু হয়। দ্বিতীয় নাম, ৭০ বছর বয়সি ফালু দাস। পরিবারের দাবি, তাঁর কাছে সব রকম কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও তাঁকে বিদেশি ঘোষণা করে ২০১৭ সাল থেকে ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দি করে রাখা হয়। আগেকার পুরো সুস্থ মানুষটার কোনও অসুস্থতার খবর তাঁর পরিবারকে জানানো হয়নি। তৃতীয় মৃতের নাম সুব্রত দে, মাত্র ৩৬ বছর বয়সে হঠাৎ কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। ১৯৫১ সালের এনআরসি তালিকায় তাঁর পূর্বপুরুষদের নাম থাকা সত্ত্বেও কী করে বিদেশি হয়েছিলেন তিনি? কোনও করণিকের অন্যমনস্ক আঙুল তাঁর নামের বানান ভুল টাইপ করায় তাঁর ঠাঁই হয়েছিল ডিটেনশন ক্যাম্পে। প্রসঙ্গত, এই তিন জনের পরিবারই মৃত্যুর পর দেহ নিতে অস্বীকার করেছিল। প্রসঙ্গত, তিনটি ক্ষেত্রেই অসহায় পরিবারগুলিকে শেষ পর্যন্ত দেহ নিয়ে শ্রাদ্ধশান্তি করতেও বাধ্য করেছে আমাদের রাষ্ট্র।
ডিটেনশন ক্যাম্পের বাইরে এ রকম আরও অনেক ‘কেস’ আছে, আইনের ভাষায় যেগুলো ‘পেন্ডিং’। আগে তার ঠিক সংখ্যা কেউ জানত না। কিন্তু এখন রাষ্ট্রযন্ত্র পাকা হিসেব করিয়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে জানিয়েছে যে, ভারত জুড়ে অবৈধ ভাবে বসবাস করা অনুপ্রবেশকারীদের কথা আপাতত বাদ দিলেও শুধু অসমেই নাকি ঘোষিত বিদেশির সংখ্যা ১৯ লক্ষের থেকে একটু বেশি, তাঁদের যে কোনও সময়ে ঢোকানো যেতে পারে ডিটেনশন ক্যাম্পে।
ওই শোকার্ত দুঃস্থ পরিবারের মূল দাবি ছিল যে— এই মৃতদের আগে ভারতীয় বলে ঘোষণা করতে হবে, নয়তো কর্তৃপক্ষ যেন দেহগুলি বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেন। রাজনৈতিক চাপ, হুমকি, ভয় পরোয়া না করে তাঁরা দশ দিন পর্যন্ত অনড় থেকেছেন এই দাবিতে। তার প্রকোপ এতটাই জোরালো ছিল যে, মধ্যস্থতা করতে বাধ্য হয়েছেন স্বয়ং অসমের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়াল। প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তাঁদের আইনি সহায়তা দেওয়া হবে। ক্যাম্পের ভিতরে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, অমানবিক আচরণ ও প্রতিটি ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের গাফিলতির ফলে সংঘটিত এই নিয়মিত মৃত্যুমিছিলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের উত্তরে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, ক্যাম্পগুলোর সার্বিক পরিস্থিতির উপর নজর দেওয়া হবে, চিকিৎসার ব্যবস্থা হবে, এমনকি বন্দিদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকেও লক্ষ রাখা হবে। আমেরিকার আইসিই (ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট)-এর আদলে বন্ড, জমির দলিল ইত্যাদি প্রদানের মাধ্যমে প্যারোলে অনেককে আপাতত মুক্তি দেওয়ার কথাও বলেছেন। কিন্তু হতদরিদ্র এই মানুষদের পরিবারগুলো বন্ডের এক লক্ষ টাকাই বা জোগাড় করবে কী করে? উকিল, মোক্তার ও অন্য মধ্যস্বত্বভোগীদের শেষ সম্বলটুকু দিয়ে তো তাঁরা এখন নিঃস্ব।
রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ, অনুপ্রবেশ রাজনীতি ও নাগরিকত্বের পুনর্নির্মাণের জাঁতাকলে পড়ে থাকা মানুষগুলোর পরিস্থিতি দেখে বোঝার চেষ্টা করছিলাম, বাইরের দুনিয়ায় এই ধরনের নীতি নির্ধারণ কী ভাবে হয়। ইংল্যান্ডের নটিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশুমনস্তত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক পল্লব মজুমদারের মতে, ইংল্যান্ড, জার্মানি, গ্রিসের মতো দেশে নাকি প্রথমে কে অনুপ্রবেশকারী আর কে উদ্বাস্তু (অর্থাৎ অর্থনৈতিক কারণে প্রব্রাজন করেছেন), সেটা খুঁটিয়ে পরীক্ষা করা হয়। সেই সময় রাষ্ট্র এঁদের আইনি পরামর্শ-সহ সমস্ত ব্যাপারেই সাহায্য করে। কেউ যদি অবৈধ অনুপ্রবেশকারী প্রমাণিত হন, তবেই তাঁকে দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করে। কিন্তু ডিটেনশন ক্যাম্পের ভিতরে অধিবাসীদের মানসিক স্বাস্থ্য থেকে সার্বিক সুস্থতার বিষয়টি রাষ্ট্র তার নিজের দায়িত্ব হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য থাকে।
আসল কথা, নাগরিকত্ব ও অভিবাসী নিয়ে রাজনীতি অনেক দেশেই হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু অর্থনৈতিক ভাবে অগ্রসর পশ্চিমি দেশগুলো হয়তো অনুপ্রবেশকারীদের বেঁচে থাকার আকুতি বা অসহায়তাকে এখনও খানিক সদর্থক ভাবে দেখার চেষ্টা করে। তাই হয়তো সমুদ্রের নীচে তৈরি ‘মিউজ়িয়ো আটলান্টিকো’ নামের মিউজ়িয়ামটি তৈরি হয়েছে— ডিঙি নৌকায় ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে যে উদ্বাস্তুরা কূল খুঁজে না পেয়ে সমুদ্রের গভীরে তলিয়ে গিয়েছেন, তাঁদের উদ্দেশে সমর্পিত এই মিউজ়িয়াম। নাগরিক অনুসন্ধানের সময়ে এইটুকু সহমর্মিতার অনুভূতি এই ভারতে আমরা ভাবতে পারি কি?
ইতিহাস বিভাগ, ডায়মন্ড হারবার মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়