ঋণ মকুব নয়, বরং কিস্তিতে শোধ করার ব্যবস্থা হোক

অবশ্য এই সরকারি পরিসংখ্যান থেকে দুর্দশার পুরো চেহারাটা বোঝা যায় না। সরকারি খাতায় নথিভুক্ত হওয়ার শর্ত— মৃত কৃষকের নিজের নামে জমি, সরকারি ব্যাঙ্কে ঋণ, এবং মৃত্যুর সময় মদ্যপ অবস্থায় না থাকা।

Advertisement

শ্রীদীপ

শেষ আপডেট: ২৩ জুন ২০১৭ ১৪:১০
Share:

বিক্ষোভ: ঋণ মকুবের দাবিতে সংগঠিত সমাবেশে উপস্থিত মধ্যপ্রদেশের কৃষকরা। নয়াদিল্লি, ১৫ জুন, ২০১৭। ছবি: এএফপি

ক থায় বলে আশায় মরে চাষা। প্রবাদ যখন সত্যি হয়ে দেখা দেয়, তখন তা মর্মান্তিক চেহারা নেয়। গত দুই দশকে প্রায় তিন লক্ষ চাষি দেনার দায়ভার থেকে চিরমুক্তি খুঁজেছেন আত্মহত্যায়। সব থেকে বেশি আত্মহত্যা ঘটেছে যে সব অঞ্চলে, তার মধ্যে অন্যতম বিদর্ভের ইয়াবতমাল জেলা। সেখানে তিন হাজারেরও বেশি কৃষক আত্মহত্যা করেছেন গত পনেরো বছরে— যাঁদের অধিকাংশই এক বা দুই হেক্টর জমির মালিক।

Advertisement

অবশ্য এই সরকারি পরিসংখ্যান থেকে দুর্দশার পুরো চেহারাটা বোঝা যায় না। সরকারি খাতায় নথিভুক্ত হওয়ার শর্ত— মৃত কৃষকের নিজের নামে জমি, সরকারি ব্যাঙ্কে ঋণ, এবং মৃত্যুর সময় মদ্যপ অবস্থায় না থাকা। মহাজনের ঋণে ঠিকা-নেওয়া জমি চাষ করে ঋণগ্রস্ত চাষি আত্মঘাতী হলে সেটা ‘কৃষক আত্মহত্যা’ বলে লিখবে না সরকার। ক্ষতিপূরণও মিলবে না। এই বাদ-পড়া চাষিদের ধরলে আত্মহত্যার সংখ্যা তিন গুণ বাড়তে পারে।

যাঁরা অতি-বিপন্ন হয়ে বেঁচে রয়েছেন, সেই চাষিদের দিকে তাকানো যাক। গত দু’দশকে চাষের জমি ভাগ হতে হতে আরও ছোট হয়েছে। সরকারি ঋণ, অনুদান, ভর্তুকির সুযোগ যতটা পৌঁছেছে ধনী চাষির কাছে, গরিব চাষি বা খেতমজুর ততটাই জড়িয়েছে চড়া সুদের ঋণে। দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে চাষের খরচ। অথচ সেই হারে বাড়েনি কৃষিঋণের অঙ্ক, বা মাণ্ডিতে নির্ধারিত ফসলের দাম। নিজস্ব গুদামের অভাবে যথেষ্ট দাম না পেলেও কৃষক বাধ্য হয়েছে ফসল বিক্রি করতে। এমনকী চাষের জন্য যেগুলো ভাল বছর, তাতেও হিরো হন্ডা উঠোনের ধার ঘেঁষে দাঁড়ায় না, মেয়ের বিয়ের পণ জোগাড় হয় না, বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাও করানো যায় না। তাই ঋণ, আরও ঋণ করতে হয় চাষিকে।

Advertisement

বিদর্ভের ইয়াবতমাল জেলায় প্রধানত বি টি তুলোর চাষ হয়। চাষির আত্মহত্যা নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে দেখেছি, যদি হেক্টর পিছু চাষের খরচ হয় ত্রিশ হাজার, হেক্টর পিছু ব্যাঙ্ক ঋণও একই অঙ্কের, হেক্টর পিছু মোট আয়ও ত্রিশ হাজার। তা হলে কৃষিনির্ভর পরিবারের হেঁশেল ধারের টাকা ছাড়া চলবে কী করে? যদিও সামান্য সুদে, এমনকী কিছু ক্ষেত্রে বিনাসুদেও ঋণ দেয় ব্যাঙ্ক। অল্প যে কয়েক জন চাষির জমি বা সামর্থ্য একটু বেশি, তাঁরা চড়া সুদে টাকা তুলে মার্চ মাসে লাইন লাগিয়েছেন, ব্যাঙ্কের ঋণ ফিরিয়ে দিয়ে আগামী মরশুমে ধার পাওয়ার যোগ্যতা বজায় রাখতে। বেশির ভাগ কৃষক হন্যে হয়ে ঘুরছেন মহাজনের থেকে তিরিশ শতাংশ সুদের হারে ধার-নেয়া টাকা পরিশোধের ব্যবস্থা করতে। কারণ, আশি শতাংশ চাষি ব্যাঙ্কের ঋণ শোধ করতে না পেরে সরকারি ঋণের আওতার বাইরে ছিটকে গিয়েছেন বিদর্ভ অঞ্চলে।

কৃষকদের প্রতি ব্যাঙ্কের ব্যবহার যথেষ্ট অসঙ্গত। কিস্তিতে ঋণ পরিশোধের সুযোগ থেকে শুধুমাত্র কৃষক শ্রেণিই বঞ্চিত। শুধু তা-ই নয়, কৃষিঋণের পুরো টাকাটা বছরের শেষে ফেরত দিতে না পারলে চাষি পরের বছর ঋণ পাওয়ার যোগ্যতা হারায়। এ অবস্থায় ঋণের অর্ধেক বা অধিকাংশ পরিশোধের ক্ষমতা যদি চাষির থাকে, তাঁকে সেই কাজে উৎসাহিত করার কোনও ব্যবস্থা নেই। যেমন, কিছু টাকা ফেরত দিলে সেই অনুপাতে ঋণ তিনি ফের পাবেন, এমন কোনও নিয়ম নেই। তাই বহু বছর আগেই ব্যাঙ্ক-বৃত্তের বাইরে ছিটকে যাওয়া এই মানুষগুলির পিঠ আর দেওয়ালের মধ্যে আজ আর কোনও ব্যবধান নেই।

আর কী ভাবেই বা হবে এ দেনা শোধ, যেখানে সেচ-বর্জিত অঞ্চলে চলেছে তুলোর চাষ? এই চাষে ঠিক সময়ে ঠিক পরিমাণে জল চাই। বর্ষার ভরসায় থাকলে যা কখনওই নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। বছরের পর বছর ফসল ভেস্তে গিয়েছে অসময়ে বৃষ্টি, বা স্বল্প বৃষ্টির জন্য। কখনও বার তিনেক বীজ ছড়িয়েও মেঘের দেখা মেলেনি। কেবলই চোখ রাঙিয়েছে সুদ আর লোকসানের অঙ্ক। ফসল বিমা ছিল, কিন্তু তার বণ্টনের ভিত্তি এমনই যে ক্ষতিগ্রস্তরা উপকৃত হননি। কারণ, অতিবৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি, যা ফসলের ক্ষতি করে, তা আজকাল প্রায়ই এতই ছোট এলাকায় (একটি কী দুটি গ্রাম) প্রভাব ফেলে, যে ব্লক স্তরে হিসেব করলে ক্ষতির আন্দাজ করা যায় না।

চাষে উৎপাদনের ঝুঁকি এতই বেশি যে চেনা মহাজন, স্বর্ণকার বা শহরবাসী আত্মীয়রাও এখন ঋণ দিতে বিমুখ। ঘটিবাটি বন্ধক রাখতেও তাঁরা নারাজ— জানেন, টাকা নিলে ফেরাবার ক্ষমতা ছোট কৃষকের আর নেই। এমনকী চাষের জমি বিক্রি করে সে টাকায় বিকল্প রোজগার খোঁজার রাস্তাও চিরতরে বন্ধ, কারণ সে কাগজ আটক ব্যাঙ্কের আলমারিতে। প্রায় সকলেই অল্পবিস্তর ব্যাঙ্কের কাছে ঋণী। সে ঋণ শোধ না হলে কাগজও ফেরত পাওয়া যাবে না। ত্রিশ হাজার টাকার ঋণের জন্য তিন লক্ষ বা তেরো লক্ষ টাকার জমি আটক। ঋণ মুক্ত বা মকুব না হওয়া পর্যন্ত, চাইলেও জমির এক অংশও বিক্রি করতে পারবে না সে। সেচের অভাবের জন্য আগ্রহী ক্রেতা পাওয়াও মুশকিল।

দু-দশক আগেও, প্রাক-বি টি যুগে অবস্থা এতটা প্রতিকূল ছিল না। দেশজ তুলোর পাশাপাশি জোয়ার, বাজরার চাষ হত। তুলোর ফলন খারাপ হলেও মানুষের ঘরে শস্যের অভাব হয়নি। বি টি-র সমর্থকরা ফলন ও লাভের মাত্রা বৃদ্ধি, এবং কীট-প্রতিরোধক্ষমতার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা ভুয়ো প্রমাণিত হয়েছে। অসংখ্য কৃষক প্রাণের মূল্যে বুঝিয়েছেন, আরোপিত এক শস্যধারা, যা একটা গোটা অঞ্চলের জলহাওয়া ও প্রথাগত শস্যধারা-বিরোধী, তা কী ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে। ইয়াবতমাল বিক্ষিপ্ত উদাহরণ নয়। ঠিক একই ভাবে সবুজ বিপ্লবের পীঠস্থান পঞ্জাবে বাসমতীর চাষ ভূগর্ভের জল দ্রুত ক্ষয় করছে, যা কৃষকের ভাগ্য আরও অনিশ্চিত করে তুলছে।

এই ছবি কি শুধু কয়েকটি অঞ্চলের? গোটা ভারতে অনাদায়ী কৃষিঋণ সাড়ে তিন গুণ বেড়েছে গত এক দশকে। জলের অভাবে, ভুল ফসল নির্বাচনে, ফসলের ঠিক মূল্য পাওয়ার অনিশ্চয়তায়, ও পর্যাপ্ত ঋণ না পাওয়ার জন্য চাষের ঝুঁকি সর্বত্র বাড়ছে। তথ্য-পরিসংখ্যান পেরিয়ে চাষির সঙ্গে কথা বললে বোঝা যায়, ঋণের বোঝার নীচে চাপা আছে টাকা ফেরত দিতে না পারার জন্য এক গভীর লজ্জাবোধ। বিশেষ করে ঋণ যদি নেওয়া হয় নিকটাত্মীয়ের থেকে, সেখানে বশ্যতা চূ়ড়ান্ত। চেনা লোক হয়তো শাসাবে না, দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে অপমানও করবে না প্রতিনিয়ত, কিন্তু সুদখোরের কটূক্তির চাইতে অধিক মর্মভেদী আত্মীয়ের ঋণ শোধ করতে না পারার লজ্জা। যা শেষ অবধি তাকে এক নির্মম সিদ্ধান্তের দিকে ঠেলে দেয়।

‌দায় আছে রাজনীতিরও। ঋণ মকুবের প্রত্যাশা যে ঋণ শোধের ক্ষেত্রে মূল বাধা, তা জেনেও প্রশাসন সে দিকে প্রলুব্ধ হয়। তাই ক্ষমতা থাকলেও শোধ করেন না বহু কৃষক। অথচ ঋণ শোধ না করলে যে ব্যাঙ্ক বা চাষি, কারও লাভ হয়নি, তা গত এক দশকের অভিজ্ঞতায় বারবার স্পষ্ট হয়েছে। অতএব দরকার ঋণ শোধ করার নিয়মে পরিবর্তন, যাতে খানিক টাকা ফেরত দিয়ে ফের ঋণ পাওয়ার যোগ্যতা চাষির বজায় থাকে। সরকারি ঋণ পেতে যাতে সে আগ্রহী হয়, তার ব্যবস্থা করা দরকার।

শিব নাদার বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষক

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement