উত্তরমেঘের স্মৃতি, সুখের মাঠ জলভরা

বর্ষা উত্তরবঙ্গের কাছে নানা অনুষঙ্গের জন্ম দেয়। প্রতিবারই মনে করিয়ে দেয় ফেলে আসা আষাঢ়-শ্রাবণের কথা। অঝোর ধারায় ডুর্য়াসের ভিজে যাওয়া, তিস্তার ফুলেফেঁপে ওঠা, বানভাসি মানুষের হাহাকার, নদীর ভাঙন এবং একই সঙ্গে স্কুলে-স্কুলে রেনি-ডে’র হঠাৎ-ছুটির আনন্দ। এ ছবির পরিবর্তন নেই। নবীন প্রজন্মকেও একই ভাবে ভাবায় বর্ষা।

Advertisement

অনিন্দিতা গুপ্ত রায়

শেষ আপডেট: ১২ জুলাই ২০১৯ ০৫:২০
Share:

সবারই সম্ভবত নিজস্ব একটা বর্ষাঋতু থাকে, যমুনারঙের মেঘ থাকে, যাকে প্রিয়নামে ডাকা যায় নির্জনে। সকলেরই থাকে খুব প্রিয়, খুব একান্ত এক বর্ষাকাল— স্বীকারে-অস্বীকারে। এর জন্য কবি হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। প্রেমিক হতে হয় শুধু। যে প্রেমের সুবাদে জীবনের প্রতিটি টুপটাপ-ঝমঝম আঁকড়ে ধরে অবিশ্রান্ত ভিজে যাওয়ার আহ্লাদ মাঝবয়সেও ময়ূরের মতো পেখম মেলতে পারে। স্থান-কাল-বয়স ভেদে যতই বদলাক মেঘবৃষ্টির পদাবলি, ঘরে ফেরার পথগুলো আলতো শ্রাবণ মেখে ঘন হয়েই থাকে সকলের বুকের ভিতর। থাকে কিছু জলভারনত চোখের অভিমান, মেঘদূতের অপেক্ষা আর জীবনের কাদাঘোলা জলে হারিয়ে যাওয়া একমুঠো বকুল।

Advertisement

বাদলদিনের নস্টালজিয়া

বর্ষারাতে তাই দমকা হাওয়া ফিরিয়ে আনে নস্টালজিয়া, যেখানে বারান্দার পাশে বোগেনভেলিয়া গাছে ভিজে ঝুপসি মা-পাখির ডানার নীচে ছানাদের গুটিসুটি। বাগানভর্তি আধডোবা জুঁই, কামিনী, গন্ধরাজ, বেলি, হাস্নুহানা আর লিলির পাপড়ি নেতিয়ে উঠে আসা তীব্র গন্ধ। শ্যাওলা ভেজা ছাদের কার্নিশে বাসি পাঁউরুটির উপর জমে থাকা সবুজ স্তরের মতো লাইকেন। রাস্তার হ্যালোজেনে অজস্র বাদলা পোকার মরণঝাঁপ। ব্যাঙেদের উল্লাসে লোডশেডিংয়ে আবছা সন্ধের কেঁপে ওঠা হ্যারিকেন-আলোয় চালেডালে বেগুনভাজায় ‘মামলেটে’ মফস্‌সলি রূপকথার আনন্দায়োজন। অঙ্কখাতার হিজিবিজি পাতার নৌকো হয়ে নিরুদ্দেশে ভেসে যাওয়া। সেখানে সোঁদা গন্ধের বয়স বাড়ে না। সেখানে পেঁপে গাছের পাতায় মাথায় জল বাঁচাতে চাওয়া নবীনের টানাটানা বিস্মিত চোখের সামনে রংধনু ঝলসে উঠলে পৃথিবী থেকে ‘দরিদ্র’ শব্দটি হারিয়ে যায়!

Advertisement

গঙ্গা-মহানন্দার পাড় থেকে উঠে আসা জীবনে প্রতিটি বর্ষা মানেই কিছু ভাঙনের গল্প। স্কুলবাড়িতে আশ্রিত বানভাসিদের ইতিকথা বিষণ্ণ করে তুলত খুব। বর্ষা মানে সে এক ভয়ানক বিড়ম্বনা। তার মধ্যেই জলে হুটোপুটি করতে দেখা স্কুলফেরত ছেলেমেয়েদের ভিড়ে কখনও নেমে পড়াও ছিল বাড়ির যাবতীয় সতর্কবার্তা ও অনুশাসন ভুলে। ইউনিফর্ম, স্কুলব্যাগ ভিজে একশা। কেডস জোড়া তখন নৌকো আর মোজা কাজে লাগত মাছ ধরায়। যদিও বাড়ি ফিরে জানা যেত, মোজা ভর্তি আসলে ছোট মাছ নয়, আসলে ব্যাঙাচি জমিয়েছি!

প্রজন্মবদল বৃষ্টিমঙ্গল

আজ মনে হয়, এ ভাবেই আমরা দুর্লভ ভেবে কত অবান্তর জিনিস কুড়োই বলেই বোধ হয় কিছু নির্মল আনন্দ আজও বেঁচে আছে জীবনে! রেনি-ডে প্রাপ্তির লোভে কম ভিজে আসা মেয়েরা রেন-ওয়াটার পাইপের নীচে দাঁড়িয়ে বা কলের জলে ভিজে একশা হয়ে দিদিমণিদের কাছে কতবার দরবার করতে গিয়েছি দলবেঁধে। হঠাৎ পড়ে পাওয়া আধবেলার ছুটিতে এত যে আনন্দ থাকে, তা কিশোরকালের মতো কেই-বা জানে! আজ ভূমিকা বদলে যখন নিজের ছাত্রীদের ওই একই ভাবে ছুটির আবেদন নিয়ে হাজির হতে দেখি, সপ্রশ্রয় স্নেহ টের পাই বুকের ভিতর! যার ডাকনাম আসলে বর্ষাকাল!

আর্দ্র হয়ে থাকাটুকুই। প্রজন্মভেদে ঋতুবদল কি আলাদা অনুভব নিয়ে আসে জীবনের নানা বাঁকে? অন্য ঋতুর কথা খুব নিশ্চিত করে না বলতে পারলেও বর্ষার বোধ হয় সত্যিই এক চিরকালীনতা আছে, যেখানে যুগ যুগ ধরে অলক্ষ্য জল বেড়ে ওঠা থাকেই। একটা কুহক, ঘোর, ঘূর্ণি, রহস্যময়তা, বিষাদ, বিরহ, মনকেমন, আশঙ্কা, নিরাপত্তাহীনতা— যাকে ছোট্ট শব্দে প্রতিস্থাপিত করাই যায়— ‘প্রেম’! অফিসটাইমে হঠাৎ ভিজে মেঘের নাম যতই ‘আহাম্মক’ রাখা হোক না কেন, মেঘ আসলে ভালবাসার প্রতিশব্দই! কলেজ-ইউনিভার্সিটির সদ্য প্রেমে পড়া ছেলেমেয়েদের কাছে প্রবল বৃষ্টি আদৌ কোনও অন্তরায় নয়, বরং ছাতার আড়াল বা পর্দাঘেরা রিকশার নিবিড়তা যথেষ্ট কাঙ্ক্ষিত। সে কথা সব কালেই সত্যি। এমন দিনেই তারে বলা যায়!

জঙ্গল-পাহাড়-বানভাসি

উত্তরবঙ্গের বহু জেলায় বর্ষাযাপনের অভিজ্ঞতা যে নিবিড় বর্ষা-অনুষঙ্গের জন্ম দিয়েছে, সেখান থেকে বলা যায়, ডুয়ার্স আর পাহাড়কে বর্ষাঋতুতে না ছুঁলে বোঝা যায় না প্রকৃত বেঁচে থাকায় কতখানি শ্রাবণজল মিশে থাকে!

সে সব আখ্যান লিখে ওঠা যায় না, বয়ান করা যায় না সে সবের! শুধু অনুভবের কাছে ঋণ বাড়িয়ে দেয়। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত প্রবল একটানা জলপতনের শব্দ, দৃষ্টিসীমা পেরিয়ে যেন দিগন্তের ওই পার থেকে, অন্য দ্রাঘিমা থেকে হা-হা ছুটে আসা বৃষ্টির বল্লম! প্রতিদিনের যাতায়াতের পথে ফুঁসে ওঠা তিস্তাকে অবিশ্বাস্য তীব্রতায় ক্রমশ উঁচু হতে দেখা! বিপদসীমা পেরোনোর সতর্কতা ও আশঙ্কা বুকে নিয়ে নির্ঘুম এপাশ-ওপাশ তিস্তাচর আর কলোনি সংলগ্ন শহর। বাড়ি, শ্মশান, রাস্তা, নদী, মাঠ সব যে কখন একাকার হয়ে একটা প্রবল জলস্রোতের রূপ নেবে! পাশের জেলায় ধস নামবে ঘনঘন! তলিয়ে যাবে লোকালয় যাবতীয় বিপন্নতা স্মৃতিতে ফিরিয়ে দিয়ে! যে কোনও মুহূর্তে পায়ের তলার মাটি জল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আর আতঙ্ক অভিমানী করে তুলবে ক্ষুব্ধ করে তুলবে প্রতিদিন! প্রশাসন না কি প্রকৃতি, কার কাছে অভিযোগ জানাবে, ভুলে যাবে জলমগ্ন মানুষগুলো! তারপর একদিন পথে নামবে শপং মল আর মাল্টিপ্লেক্স প্রজন্ম নামে অভিহিত মুখগুলোই। প্রতিবারের মতো ওরাই ত্রাণ জোগাড় করে পৌঁছে যাবে বানভাসি এলাকায়।

সারাজীবন বৃষ্টি পড়ে

তারপরও বৃষ্টি পড়তেই থাকবে অনন্ত আষাঢ়ে-শ্রাবণে, যেখানে চিঠি না লেখার দিনগুলোয় মেঘের খামে হঠাৎ কোনও ভেজা ঝাউপাতা উড়ে আসবে। সে মনে করাবে, আসলে দ্বীপবাসী আমরা অনেকদিনই। আসলে, বিপন্ন আমরা এ রকমই। আসলে, লোভের কাছে মাথা নত করা উন্নতির রথ বড় অসহায় প্রকৃতির হাতে। আসলে, আমরা সকলেই আছি বুকজলে— কেউ জানি, কেউ জানি না!

আসলে এক মাঠের দিকেই নিষ্পলক তাকিয়ে রয়েছে আমাদের সারাবেলা— সেই যেখানে সারাজীবন বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টি পড়ে!

(লেখক ময়নাগুড়ির খাগড়াবাড়ি উচ্চমাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষক। মতামত ব্যক্তিগত)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement