অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন।
আজ থেকে দুই সহস্রাব্দ আগে কবি হোরেস বলেছিলেন, ‘যথা সময়ে মূর্খামি প্রদর্শন বেশ জরুরি কাজ।’ কবির কথা শিরোধার্য করে এই ‘যথা সময়ে’ আমি ‘মূর্খামি’ (silliness)-র সপক্ষে কিছু বলতে চাই।
আমার প্রথম মূর্খ চিন্তাটি এই প্রকার— নিয়মবিদ্যার সীমানাগুলি (Disciplinary boundaries) বেশ কিছু ঘোরালো সন্দেহের উদ্রেক করে। পদার্থবিজ্ঞানীকে পোস্ট-মডার্ন সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়। সৃষ্টিতত্ত্ববাদীদের ঝেড়ে ফেলতে জীববিজ্ঞানীদের দীর্ঘ সময় লাগে। অর্থনীতিবিদ আর সমাজবিজ্ঞানীদের ক্ষেত্রে সন্দেহটা আরও জোরালো। আর এক কবি ডব্লিউ এইচ অডেন তাঁর সন্দেহবাদকে এই ভাবে ব্যক্ত করেছিলেন—
কদাচ সংখ্যাতত্ত্ববিদদের সঙ্গে এক পঙ্ক্তিতে বসো না/ কদাচ সমাজবিজ্ঞান কপচিও না।
বেশ, আমরা কিন্তু এখানে এক নির্জন কোণে বসে সমাজবিজ্ঞানই ‘কপচানো’ (commit)-র চেষ্টায় রয়েছি। সেই সঙ্গে এটাও দেখা প্রয়োজন যে, বিজ্ঞান আর সংস্কৃতির এই গুরুত্বপূর্ণ সম্মিলনের অবকাশে অন্যরা কী করতে চান।
একটা ব্যাপার আপনাদের বলতে চাই, শৈশবে বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সংসর্গে আসার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। সেই মানুষটির আরও নানা কৃতির সঙ্গে এটাও বলা প্রয়োজন যে, তিনি ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। এটাও মনে রাখা প্রয়োজন যে, ভারত ও বাংলাদেশ— এই দুই দেশের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা তিনিই। শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ এক আশ্চর্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে আমার পিতামহ শিক্ষকতা করতেন। আমি এই বিদ্যালয় চত্বরেই জন্মগ্রহণ করি। এই বিদ্যালয়ের লক্ষ্য ছিল শিক্ষার্থীদের একই সঙ্গে স্থানীয় আর বিশ্বায়িত শিক্ষা দান করা। রবীন্দ্রনাথ বিষয়টিকে এই ভাবে দেখেছিলেন— মানবের যা কিছু কীর্তি আমরা দেখি আর উপভোগ করি না কেন, উৎস নির্বিশেষে তা আমাদের সম্পত্তি হয়ে দাঁড়ায়। তাঁর বিশ্বজনীন, সহিষ্ণু আর যুক্তিশীল মতাদর্শ আমার চিন্তনে গভীর প্রভাব রেখেছে। এই ভেদ সৃষ্টিকারী সময়ে দাঁড়িয়েও আমি তাঁর ভাবনাগুলিকে স্মরণে আনি।
আরও পড়ুন: এর পরে লম্বা একটা ছুটিতে যাব: অভিজিৎ
১০ ডিসেম্বর, ১৯৯৮, স্টকহলমে নোবেল পুরস্কার নিচ্ছেন অমর্ত্য সেন।
ভারতীয় পদার্থবিজ্ঞানী চন্দ্রশেখর যখন নোবেল পুরস্কার পান, তিনি রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতা উদ্ধৃত করেছিলেন। যেখানে চিত্তের মুক্তির প্রসঙ্গে বলা হয়েছিল— “যেথা তুচ্ছ আচারের মরুবালুরাশি/ বিচারের স্রোতঃপথ ফেলে নাই গ্রাসি।” আমি চন্দ্রশেখরের মুখে রবীন্দ্রনাথের এই চিত্ত-মুক্তির প্রশংসার বাণীর প্রশংসা করছি।
আরও পড়ুন: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল বক্তৃতা
এ বারে একটা সত্যিকারের বোকাটে চিন্তার কথায় আসি। এই মুক্ত চিন্তার যুক্তিপ্রবাহ থেকে অর্থনীতিবিদদেরও কিছু শেখার রয়েছে। কোনও গোঁড়ামি থেকে বেরিয়ে আসতে তা সাহায্য করে। (উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, এমন প্রশ্নের সামনে আমাদের প্রায়শই পড়তে হয়— আপনি বাজারের স্বপক্ষে না বিপক্ষে? রাষ্ট্রের করস্পর্শকে সমর্থন করেন, না করেন না? কোনও ‘কিন্তু’, ‘যদি’ বাদ দিয়ে উত্তর দিন।) এমন প্রশ্ন এলে বিশ্লেষণকে সরিয়ে রেখে স্লোগানের ছত্রছায়ায় গমন— এক বৃহত্তর গোঁড়ামির দ্বারা চালিত হওয়া। হয় এটা হও, নয়তো ওটা। আসলে আমাদের প্রয়োজন বিচারের অবারিত স্রোতঃপথ। যা রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন, চন্দ্রশেখর চেয়েছিলেন। আমরা অর্থনীতিতেও তাকেই চাই, একই কারণে চাই। আজকের সন্ধ্যায় এটাই আমার শেষ বোকাটে ভাবনার বহিঃপ্রকাশ।
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ