অবস্থা: শালবনির নতুন স্টেডিয়ামের মাঠ। নিজস্ব চিত্র
খরচ করে বসানো হয়েছিল বিদেশি ঘাস। কিন্তু বিদেশি ঘাসের গালিচা ফুঁড়ে এখন হাওয়াতে মাথা দোলায় দেশি ঘাসের ফুল। সুযোগ বুঝে অল্পস্বল্প বংশবিস্তার করেছে আগাছারাও। মাঠে খেলোয়াড়দের পা পড়ে না। ফলে উইপোকা বসত করেছে ঢিপি করে। পশ্চিম মেদিনীপুরের শালবনি ব্লকের নতুন স্টেডিয়ামের ছবি। গত ছ’বছরেও স্টেডিয়ামের কাজ শেষ করে খেলা শুরু করা যায়নি। অথচ খরচ হয়ে গিয়েছে প্রায় সাত কোটি টাকা।
নতুন স্টেডিয়ামে কবে খেলার আসর বসবে তা এখনও অজানা। কিন্তু এর মধ্যেই অভিযোগ উঠতে শুরু করেছে, গোড়াতেই গলদ হয়ে গিয়েছে। স্টেডিয়ামের জন্য ভুল জায়গা বাছাই করা হয়েছে। শালবনি ব্লকের এক প্রান্তে অবস্থিত এই স্টেডিয়ামে পৌঁছনোই একটা অভিযান।
জঙ্গলমহলের ছেলে মেয়েদের খেলার উন্নতির জন্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসার পরেই ঝাড়গ্রামের নয়াগ্রামে ও পশ্চিম মেদিনীপুরের শালবনিতে দু’টি স্টেডিয়াম তৈরির জন্য অর্থ বরাদ্দ করেছিলেন। ২০১৩ সালে কাজ শুরু করে পূর্ত দফতর। মুখ্যমন্ত্রী ২০১৬ সালে নয়াগ্রাম স্টেডিয়াম ও ২০১৭ সালে শালবনি স্টেডিয়ামের উদ্বোধন করেন। ২০১৮ সালে নয়াগ্রাম স্টেডিয়াম পূর্ত দপ্তর থেকে জেলা প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর হয়েছে। কিন্তু শালবনি স্টেডিয়াম এখনও পূর্ত দফতর থেকে জেলা প্রশাসনের দায়িত্বে আসেনি। ফলে খেলাধুলোও শুরু হয়নি। ২০১২ সালে নয়াগ্রাম স্টেডিয়ামের জন্য বরাদ্দ হয় ৩ কোটি ৫৭ লক্ষ টাকা। শালবনির জন্য মঞ্জুর হয় ৫ কোটি ৪১ লক্ষ টাকা।
নয়াগ্রামে ৬.৬ একর জায়গায় গড়ে ওঠে স্টেডিয়াম। হস্তান্তরের কাজ না মেটায় সমস্যায় পড়েছিল নয়াগ্রামও। মাঠের ঘাস চুরি গিয়েছিল। স্টেডিয়ামে সাপের উপদ্রব দেখা দেয়। সংবাদপত্রে স্টেডিয়ামের খবর প্রকাশিত হওয়ার পরে ২০১৮ সালে হস্তান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। জেলা প্রশাসন নয়াগ্রাম পঞ্চায়েত সমিতিকে স্টেডিয়াম দেখাশোনার দায়িত্ব দেন। এখন নয়াগ্রাম স্টেডিয়ামে মাঝে মধ্যে ব্লক স্তরের প্রতিযোগিতা হচ্ছে। নয়াগ্রাম থানা বালিকা বিদ্যালয়ের মেয়েরা সুব্রত কাপে কয়েকবার রাজ্য চ্যাম্পিয়ান হয়ে জাতীয় স্তরের প্রতিযোগিতায় যোগ দিয়েছে। এই বিদ্যালয়ের নিজস্ব খেলার মাঠ নেই। নয়াগ্রামের বিডিও বিদ্যালয়ের মেয়েদের স্টেডিয়ামে অনুশীলনের অনুমতি দিয়েছেন। সেখানে তারা নিয়মিত ফুটবল অনুশীলন করছে।
কিন্তু শালবনির ৬ নম্বর ভীমপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের কয়মাতে ১৩.৪ একর জায়গায় নির্মীয়মাণ স্টেডিয়ামের ভাগ্যে তা-ও ঘটেনি। স্টেডিয়ামে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী ৭০ মিটার চওড়া ও ১১০ মিটার দীর্ঘ মাঠ বানানো হয়। মাঠে বসানো হয়েছে ‘মেক্সিকান’ ঘাস। মাঠের পাশে তৈরি হয়েছে ছ’টি ট্র্যাক। এ ছাড়াও পোলো, ভলিবল, লং জাম্প, হাই জাম্প, ট্রিপল জাম্পের জায়গা রয়েছে। শটপাট, ডিসকাস ও জ্যাভলিন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা যাবে। রাতে খেলার জন্য হাই-মাস্ট আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্টেডিয়ামের পশ্চিম দিকে একটি গ্যালারি তৈরি হয়েছে। দু’হাজার দর্শক বসে খেলা দেখতে পারবেন। এ ছাড়াও অতিথিদের জন্য ২৫টি আসনের ভিআইপি গ্যালারি আছে। খেলোয়াড়দের জন্য রয়েছে দু’টি চেঞ্জিং রুম। ওয়াশ রুম। ২০১৮ সালের গোড়ার দিকে ক্রীড়া দফতরের হাতে স্টেডিয়াম হস্তান্তরের জন্য চিঠি পাঠায় পূর্ত দফতর। রাজ্য ক্রীড়া ও যুব কল্যাণ দফতরের আধিকারিকেরা মার্চ মাসে স্টেডিয়াম দেখতে আসেন। কিন্তু স্টেডিয়ামের কাজে আধিকারিকেরা সন্তোষ প্রকাশ করেননি বলেই খবর। আরও কিছু কাজ করার জন্য পূর্ত দফতরকে জানায় পর্যবেক্ষক দল। পূর্ত দফতর বরাদ্দ টাকা শেষ হয়ে গিয়েছে বলে জানায়। বকেয়া কাজের জন্য পূর্ত দফতর প্রস্তাব জমা দেয়। গত বছর মার্চ মাসেই ক্রীড়া দফতর বাকি কাজের জন্য প্রায় দেড় কোটি টাকা বরাদ্দ করে।
মুখ্যমন্ত্রীর উদ্বোধনের পরেও স্টেডিয়ামে খেলাধুলো শুরু না হওয়ায় শালবনি এলাকার ছেলে মেয়েদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছিল। তাই ২০১৮ সালে মুখ্যমন্ত্রীর জেলা সফরের আগে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শালবনি স্টেডিয়ামে খেলা শুরুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। মাঠে গজিয়ে ওঠা আগাছা পরিষ্কার করা হয়। মেয়েদের একটি প্রীতি ম্যাচ দিয়ে স্টেডিয়ামে খেলা শুরু হয়। স্টেডিয়ামের বাকি কাজ চলার পাশাপাশি মাঠটি ঠিক রাখার জন্য মহকুমা ক্রীড়া সংসদের পক্ষ থেকে মাঝে মধ্যে কিছু খেলার আয়োজন করা হয়েছে। তবে পূর্ত দফতর জেলা প্রশাসনের হাতে স্টেডিয়াম হস্তান্তর না করায় জোর কদমে খেলাধুলো শুরু হয়নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়মা গ্রামের এক যুবক জানান, ছ’বছর হয়ে গেলেও স্টেডিয়াম তৈরির কাজ শেষ হল না। এখন মাঠের মধ্যে জঙ্গল হয়ে রয়েছে। উই ঢিপি হয়ে গিয়েছে। বৃষ্টি হলে মাঠে জল জমে যায়। কয়েক কোটি টাকা খরচ করে কি কাজ হচ্ছে বোঝা যাচ্ছে না।
এক ক্রীড়াবিদের অভিযোগ, জনবহুল এলাকায় স্টেডিয়াম করা উচিত। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল থাকা উচিত। শালবনি স্টেডিয়ামটি ব্লকের শেষপ্রান্তে হয়েছে। বাস চলাচলের রাস্তা থেকে প্রায় এক কিলোমিটার ভেতরে একটি গ্রামের মধ্যে। এখানে যে কোনও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, ফুটবল বা ক্রিকেট প্রতিযোগিতার আয়োজন করলে সবার যাতায়াতের অসুবিধে হবে। বাস থেকে নেমে এক কিলোমিটার হাঁটতে হবে। তাঁর দাবি, স্টেডিয়ামটি পিরাকাটায় হলে সকলের যাতায়াতের সুবিধে হত। শালবনির এক ক্রীড়া আধিকারিক জানান, স্টেডিয়ামটি ব্লকের একপ্রান্তে হওয়ায় ওখানে নিয়মিত খেলার আয়োজন করা মুশকিল হবে। ওখানে আবাসিক প্রশিক্ষণ শিবির করার উপর জোর দেওয়া হবে। মেদিনীপুর মহকুমা ক্রীড়া সংস্থার যুগ্ম সম্পাদক সন্দীপ সিংহ আশ্বাস দিয়েছেন, ‘‘খুব তাড়াতাড়ি হস্তান্তর প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করে পঞ্চায়েত সমিতিকে দায়িত্ব দেওয়া উচিত।’’
ছ’বছর পরেও স্টেডিয়ামে খেলা সেভাবে শুরু হল না কেন? পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা যুব আধিকারিক প্রভাংশু হালদার বলেন, ‘‘পূর্ত দফতর বাকি কাজ শেষ করেছে। পূর্ত দফতরের পক্ষ থেকে হস্তান্তর করার জন্য জানানো হয়েছে।’’ তিনি জানান, বিষয়টি রাজ্য ক্রীড়া দফতরে জানানো হয়েছে। হস্তান্তরের কাজ সম্পূর্ণ হলেই স্টেডিয়ামে জোর কদমে খেলাধুলো শুরু হবে। আশা তাঁর।