গ্রাফিক: সৌভিক দেবনাথ
“আমরা শিখেছি যে মনুষ্য জীবনের প্রতি সম্মানের পাঠ দিতে গেলে তার শ্রেষ্ঠ উপাদান নিহিত রয়েছে আইনের নামে জীবন হরণ করতে অস্বীকার করার মধ্যে” (We have learned that the best means to teach respect for human life consists in refusing to take life in the name of law)।
—১৯৬৩ সালে বেলজিয়ামের আইনমন্ত্রী
এটা পড়লেই প্রশ্ন উঠবে মনের মধ্যে, যারা নৃশংস অপরাধ করেছে এবং আইন মোতাবেক (হায়দরাবাদ কায়দায় নয়) সুষ্ঠু বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অপরাধীর দোষ সাব্যস্ত হয়েছে, তার তো মৃত্যুদণ্ড/চরম শাস্তিই প্রাপ্য! না হলে সম্ভাব্য অপরাধীরা উৎসাহিত হবে। তার থেকেও বড় কথা, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার কি যথার্থ ন্যায়বিচার পাবে মৃত্যুদণ্ড না হলে?
হায়দরাবাদে ভুয়ো সংঘর্ষে চার জন অভিযুক্তকে পুলিশ ঠান্ডা মাথায় খুন করার পর, বর্তমান প্রধান বিচারপতি বলেন, প্রতিহিংসা ন্যায়বিচারের ধারণাকে তুলে ধরে না। আশির দশকে বিখ্যাত বচন সিংহ মামলায় সংখ্যালঘিষ্ঠ রায়ে সুপ্রিম কোর্টের তত্কালীন বিচারপতি পি এন ভগবতীও জনসমর্থনের তত্ত্বের অসারতা নিয়ে আলোচনাকালে বলেছিলেন, ‘‘নৃশংসতার একটি প্রাথমিক আবেগই হল প্রতিশোধ যা সাংস্কৃতিক মানসিকতার অভাব এবং পরিশুদ্ধ ভাবনাহীনতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়’’ (Revenge is an elementary passion of brute and betrays lack of culture and refinement)।
ভিক্টিমের পরিবার, বহু সাধারণ মানুষ, মিডিয়ার একাংশ তা মানতে নারাজ। কিন্তু প্রশ্ন হল: প্রাণের বদলে প্রাণ কি ন্যায়বিচারের মাপকাঠি হতে পারে বর্তমান যুগে? তীব্র দ্বন্দ্ব শুরু হয় এখান থেকেই। একে ওকে ফাঁসিতে ঝোলাও, এই বিষাক্ত পরিবেশের মধ্যে দাঁড়িয়ে পৃথিবীর মানবাধিকার দর্শন ও আন্দোলন স্পষ্ট ভাবে বলে, শাস্তির প্রথা হিসেবে শর্ত নিরপেক্ষ ভাবে ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে মৃত্যুদণ্ডের বিলোপ চাই।
আরও পড়ুন: কিছু মানুষ যারা আসলে মানুষই না, রাষ্ট্রকে তাদের ঝেড়ে ফেলতে হবেই
এ কথা কেউ অস্বীকার করে না যে পৃথিবীর সর্বত্র এক সময়ে মৃত্যুদণ্ড ছিল, দৈহিক শাস্তি ছিল, অঙ্গচ্ছেদন ছিল। ফুকো দেখিয়েছেন— সভ্যতার, মানবতার ধারণা যত পাল্টেছে, শাস্তি সম্পর্কে ধারণা (ধীরে ধীরে হলেও) তত পরিবর্তন ঘটেছে। মৃত্যুদণ্ডের সর্বজনীনতাকে চ্যালেঞ্জ করে মৃত্যুদণ্ডের বিলোপের সর্বজনীনতার ধারণা দেশে দেশে গৃহীত হয়েছে/হচ্ছে। ১৩০টির বেশি দেশ মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে তার বিলোপ ঘটিয়েছে। উল্টো দিকে ভারত ছাড়াও চিন, আমেরিকার কিছু প্রদেশ, নাইজিরিয়া-সহ বিভিন্ন ইসলামিক দেশ ম়ৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছে। ইউরোপে একমাত্র বেলারুশেই মৃত্যুদণ্ড হয়। সারা পৃথিবীতে এমন রাষ্ট্রের সংখ্যা ৬০-এর মতো।
কেন মৃত্যদণ্ড বিলোপের পক্ষে ধীরে ধীরে জনমত শক্তিশালী হচ্ছে? মোটা দাগে বলা যেতে পারে, তিনটে কারণে:
এক) মৃত্যুদণ্ড শেষ বিচারে নিষ্ঠুর, অমানবিক, মর্যাদাহানিকর শাস্তিদান। এটাও একটা পরিকল্পিত আইনি হত্যা। এটাও একটা হিংস্র কাজ এবং যে কোনও হিংসাত্মক কাজের মতোই হিংসাকে এটি পরিবর্ধিত করে।
দুই) মৃত্যুদণ্ড যে প্রতিষেধক বা প্রতিরোধকারী, এমন কোনও প্রভাব পরিলক্ষিত হয়নি। যে সমস্ত দেশে মৃত্যুদণ্ড নেই, সে সমস্ত দেশে অপরাধ বেড়ে গিয়েছে— এমন কোনও তথ্য সমীক্ষা করে রাষ্ট্রপুঞ্জ পায়নি।
তিন) এটা এমন একটি শাস্তি, যা কার্যকর করার পর ফিরিয়ে নেওয়া যায় না। পৃথিবী জুড়ে ভুরিভুরি নিদর্শন আছে, যেখানে নির্দোষের উপর এই দণ্ড যথেচ্ছ ভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে।
আমেরিকা, ভারত- সহ বিভিন্ন দেশের সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, মৃত্যুদণ্ড বহু ক্ষেত্রে জাতিগত, পৌত্তলিক, ধর্মীয় এবং কৃষ্ণাঙ্গ অনগ্রসর শ্রেণির বিরুদ্ধে দমনের যন্ত্র হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
আরও পড়ুন: শিউরে উঠেছিল গোটা দেশ, কী হয়েছিল দিল্লির সেই ভয়ঙ্কর রাতে
মৃত্যুদণ্ড বিলোপকারীরা তথ্যপ্রমাণ দিয়ে দেখিয়েছে, যে কোনও অপরাধই সংশোধন যোগ্য। ভারতে জয়প্রকাশ নারায়ণ, রামকৃষ্ণ মিশন-সহ একাধিক ব্যক্তিত্ব বা প্রতিষ্ঠান দুর্ধর্ষ, ভয়ঙ্কর মানুষদের পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। সমাজ উপকৃত হয়েছে। সমাজের মধ্যে তাঁরা বার্তা নিয়ে গিয়েছেন যে, অপরাধ কোনও সমাধান নয়। তাঁরা অনুতপ্ত। তাঁদের অবদমিত সুকুমার প্রবৃত্তি জেগে ওঠায় সমাজ উপকৃত হয়েছে, নানা ধরনের প্রতিভার স্ফুরণ ঘটেছিল। রামকৃষ্ণের মতো বিচারপতি কৃষ্ণ আয়ার বলেছিলেন— অপরাধকে ঘৃণা করা উচিত, অপরাধী/মানুষকে নয়। বিচারব্যবস্থা শাস্তি দেবে অপরাধের, মানুষটিকে ফিরিয়ে দেবে সমাজে। তা না হলে ব্যক্তিহত্যা, মৃত্যুদণ্ড হত্যার শৃঙ্খলকেই বাড়িয়ে চলবে।
মৃত্যুদণ্ড দেওয়াটা শেষ বিচারে সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতির মনোগত ধারণার উপর নির্ভরশীল। ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৬ সালের মধ্যে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের মৃত্যুদণ্ড সংক্রান্ত ৭০টি রায়ের বিশ্লেষণ করে গবেষক এআর ব্ল্যাকশিল্ড দেখিয়েছেন, মৃত্যুদণ্ড হওয়া বা না হওয়া নির্ভর করেছিল বহুলাংশে বিচারপতিদের হত্যা সংক্রান্ত এবং অপরাধী সম্পর্কে নিজ নিজ ধারণার উপর। আশির দশকের শুরুতেই মৃত্যুদণ্ডের সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে মামলা হয়। কোনও রায় তাকে বাতিল করতে বলেনি। কিছু ক্ষেত্রে সংখ্যালঘিষ্ঠ বিচারপতিরা অবশ্য (যেমন পি এন ভগবতী, কৃষ্ণ আয়ার) মৃত্যুদণ্ডকে অসাংবিধানিক বলেছেন। মৃত্যুদণ্ডের সুযোগ আরও কমিয়ে দেওয়ার জন্য বিখ্যাত মচ্ছি সিংহ মামলা (১৯৮৩) উল্লেখের দাবি রাখে। শাস্তি দেওয়ার আগে বিচারপতিকে দেখে নিতে হবে কী কী ইতিবাচক উপাদান রয়েছে যা পর্যালোচনা করে অপরাধীর সাজা নির্ধারণ বা হ্রাস করা যায়।
হেতাল পারেখের ঘটনার পরে, ধনঞ্জয়ের ফাঁসি হয়ে যাওয়ার পরে, একই ধরনের ঘটনায় সাজা দিতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি সত্যব্রত সিন্হা প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘বিরল ঘটনার মধ্যে বিরলতম’ ঘটনার ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার মানদণ্ড নিয়ে। বলেছিলেন, আদালত বিভিন্ন ঘটনায় বিভিন্ন ধরনের মানদণ্ড স্থির করেছে। সুপ্রিম কোর্ট শাস্তিদানের নীতি পরিষ্কার ভাবে গড়ে তুলতে পারেনি।
বছর তিনেক আগে, দু’জন গবেষক তথ্য প্রমাণ-সহ দেখিয়েছেন, ধনঞ্জয় নির্দোষ ছিলেন। বস্তুত, এই মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ষষ্ঠ পংক্তিটি পড়লেই বোঝা যাবে, ন্যায় বিচারের নামে কী অন্যায়টা করা হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্ট স্বীকার করেছিল, পুরো মামলাটা দাঁড়িয়ে ছিল পরোক্ষ প্রমাণের উপর। আর, তার ভিত্তিতেই পুরোপুরি সংশয়াতীত না হয়ে ফাঁসির আদেশ হতে পারে? যেখানে বেকসুর হওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল ছিল।
রাষ্ট্রপতি কালামের কাছে যে সমস্ত প্রাণ ভিক্ষার আবেদন জমা পড়েছিল, সেগুলো পড়ে কালাম মন্তব্য করেছিলেন, ৯৯ শতাংশ ঘটনাতে সমাজের গরিবতম মানুষই যুক্ত এবং মিথ্যা মামলায় তাঁদের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হয়েছে।
আর একটি কথা উল্লেখের দাবি রাখে। বহু ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্ট মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছে অ- আইনি যুক্তির প্রয়োগ করে। যেমন, সম্মিলিত বিবেক (collective conscience) নামক এক বিমূর্ত ধারণার নাম করে।
মানবাধিকার আদর্শও প্রশ্ন তোলে যে, ‘বিরল ঘটনাগুলোর মধ্যে বিরলতম’ স্থির হবে কী করে? অপরাধ পরিকল্পনার বিচারে, না প্রয়োগে, না অপরাধ সংঘটিত করার পরে সাক্ষ্যপ্রমাণ লোপের বিচারে? কেউ জানে না। বিচারপতিদের মনোগত ধারণার উপরেই আসলে তা নির্ভরশীল।
আর আমাদের দেশে নিয়ম হল, সাধারণ ভাবে সর্বোচ্চ সাজা হবে যাবজ্জীবন। মৃত্যুদণ্ড উক্ত বিশেষ ক্ষেত্রে। প্রশ্ন হল, একই ধরনের ঘটনায় যদি যাবজ্জীবন হয়, তা হলে কী ন্যায়বিচার হয় না? ভিক্টিমের ইনসাফ হয় না?
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯৬৬ সালের আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারগুচ্ছের সনদে স্বাক্ষরদানের সময়ে (১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭৬) ভারত অঙ্গীকার করেছিল, তারা ধীরে ধীরে মৃত্যুদণ্ড বিলোপ করে দেবে। তা তো করেইনি, উল্টে ক্রমাগত নানা অপরাধের ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ড বাড়িয়েই চলেছে।
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, প্রথা হিসেবে মৃত্যুদণ্ড থাকবে কি থাকবে না, তা শুধুমাত্র সুপ্রিম কোর্টের ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল নয়। আরও বৃহত্তর মানবাধিকারের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, আইনের সীমানার বাইরে গিয়ে অপরাধী ব্যক্তির জীবনবৃত্তান্ত, অপরাধ প্রবণতার উত্স, আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট বিচার করা দরকার। অপরাধীর অনুশোচনা, অনুতপ্ত মনোভাব জাগছে কিনা তা মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দিয়ে যাচাই করার দাবি করে। সুকুমার প্রবৃত্তিগুলোকে জাগিয়ে তোলা, সংশোধিত হয়ে যাতে সু-নাগরিক ফিরে আসতে পারে তার চেষ্টা করার কথা মানবাধিকার আদর্শ প্রতিনিয়ত বলে।
(লেখক মানবাধিকার কর্মী)