দর্শনবিদ অরিন্দম চক্রবর্তী সম্প্রতি লিখিয়াছেন, স্বার্থসন্ধানী, অকল্যাণকামী কথাকে সত্য অর্থে ‘শব্দ’ বলা চলে না। নরেন্দ্র মোদী এনডিএ-র নবনির্বাচিত সাংসদদের বলিয়াছেন, সকলের সহিত থাকিয়া সকলের উন্নয়নের জন্য কাজ করিবার পাশাপাশি আর একটি কর্তব্য পালন করিতে হইবে— সকলের বিশ্বাস অর্জন করিতে হইবে। এহ বাহ্য। তাঁহার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা: সংখ্যালঘুদের বিশ্বাস অর্জন যেন নূতন পর্বের অন্যতম লক্ষ্য হয়। প্রধানমন্ত্রীর এই উক্তিকে অকল্যাণকামী বলিবার কোনও প্রশ্ন ওঠে না। কথাটি স্বার্থসন্ধানী কি না, তাহা লইয়া অবশ্য দ্বিমত থাকিতে পারে। কেহ বলিতে পারেন, সংখ্যালঘু-বিদ্বেষের অভিযোগে কলঙ্কিত ভাবমূর্তি কাটাইতেই এমন সদুক্তি, বিপুল নির্বাচনী সাফল্যের পরে ও প্রধানমন্ত্রীর আসনে পুনরধিষ্ঠিত হইবার পূর্বে দেশের ও দুনিয়ার নিকট ‘ভাল সাজিবার’ কৌশলমাত্র। এই সংশয়কে ছিদ্রান্বেষীর কুবাক্য বলিয়া উড়াইয়া দেওয়া কঠিন। অভিযোগ অহেতুক নহে, কলঙ্কও নূতন নহে। এবং নির্বাচনের প্রচারপর্বেও সপারিষদ প্রধানমন্ত্রীর কথায় ও কাজে অন্ধকার গাঢ়তর হইয়াছে। তাঁহার ভক্তরাও নিশ্চয় জানেন, বিদেশি পত্রিকার প্রচ্ছদ-নিবন্ধে ভারতের প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে ‘বিভাজনের নায়ক’ অভিধা মুদ্রিত হইলে দেশের গৌরব বাড়ে না। এই সব সমালোচনা যদি তাঁহাকে সংখ্যালঘুর বিশ্বাস অর্জনের আহ্বান ঘোষণায় উদ্বুদ্ধ করিয়া থাকে, তবে বুঝিতে হইবে, আন্তর্জাতিক সমালোচনা এমনকি এই ভারতেও নিষ্ফল নহে।
অতঃপর? প্রধানমন্ত্রীর কথা কাজে রূপান্তরিত হইবে, না কথামৃতই সার হইবে? লক্ষ টাকার প্রশ্ন। গত পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা ভরসা দেয় না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের নির্দেশ শিরোধার্য— মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ। সুতরাং ভারতবাসী, কেবল সংখ্যালঘু নহে, সমস্ত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ভারতবাসী বুক বাঁধিয়া বিশ্বাস করিতে চাহিবেন যে, নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁহার সহকর্মীরা পূর্বাশ্রমের পথ ছাড়িয়া নূতন পথে হাঁটিবেন। বিশ্বাস অর্জনের পথ। যথার্থ সর্বজনীন অগ্রগতির পথ। রাজধর্মের পথ। যে ধর্মের কথা প্রায় দুই দশক আগে প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে স্মরণ করাইয়া দিয়াছিলেন। বিলম্বে হইলেও ধর্মের পথে প্রত্যাবর্তন সতত বিধেয়।
কিন্তু সে জন্য অবিলম্বে প্রধানমন্ত্রীকে তৎপর হইতে হইবে। প্রথমত, সরকার তথা দলের নীতি ও আচরণে সংখ্যালঘু মানুষের প্রতি, কেবল বিদ্বেষ নহে, বিরাগের কাঁটাগুলিকেও সমূল উৎখাত করা আবশ্যক। নাগরিকত্ব বিল হইতে শুরু করিয়া ‘গোরক্ষা’— সংখ্যালঘু দমনের রকমারি প্রকরণে মোদী সরকার গত পাঁচ বছরে আপনাকে সজ্জিত করিয়াছে, সেগুলি সম্পূর্ণ বর্জনীয়। দ্বিতীয়ত, অনুগামী ‘অত্যুৎসাহী’রা যাহাতে সংখ্যালঘুর উপর চড়াও হইবার সাহস না পায়, সে জন্য তাহাদের দ্বিধাহীন ভাষায় নির্দেশ দেওয়া এবং কেহ তেমন অপরাধ করিলে তাহার কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা নায়কদের কর্তব্য। ইতিমধ্যেই একাধিক রাজ্যে আবারও গরুর নামে হিংস্র আক্রমণের পরিচিত ঘটনা পুনরাবৃত্ত। কোন রাজ্যের সরকারে কোন দল ক্ষমতায় আছে, তাহার অসার আলোচনা ছাড়িয়া এই বিদ্বেষের নৈতিক দায় এবং তাহার প্রতিকারের দায়িত্ব সঙ্ঘ পরিবারের রাজনীতিকদেরই স্বীকার করিতে হইবে। ভাবের ঘরে চুরি করিয়া বিশ্বাস অর্জন করা যায় না। সংখ্যালঘু মানুষ যদি অতঃপর নরেন্দ্র মোদীর রাজত্বে নির্ভয়ে জীবনযাপন করিতে পারেন, তাহা হইলেই তাঁহাদের বিশ্বাস ফিরিবে— এই বিশ্বাস যে প্রধানমন্ত্রী তাঁহাদের সহিত ছলনা করেন নাই, সত্য বলিয়াছেন। এনডিএ-র সাংসদদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান যদি স্বার্থসন্ধানী হয়, তাহাতেও ক্ষতি নাই, কথামতো কাজ করিলেই দেশের মানুষ তাঁহার কথাকে কেবল শব্দ নহে, শব্দব্রহ্ম বলিয়া স্বীকার করিবেন। দর্শনবিদের ন্যায় কঠোর হইলে আমজনতার চলে না।