অকারণ চিকিৎসায় যন্ত্রণা দীর্ঘ করা কি পাপ নয়?

এ বার তবে এসো

যা নেই মহাভারতে, তা নেই ভারতে। কিন্তু মহাভারতে যা কিছু আছে, আজকের ভারতে তা কি আছে? আছে কি এমন কোনও কর্তৃত্বের সুর যা মনে করিয়ে দেয়, জীবন পূর্ণ হলে যেতে দেওয়াই কর্তব্য?

Advertisement

স্বাতী ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২০১৭ ০১:০৫
Share:

জ্যেঠামশায় এসে দাঁড়িয়েছেন ভ্রাতুষ্পুত্রের কাছে। বিদায় চান। ভ্রাতুষ্পুত্র শুধু সন্তানহীন বৃদ্ধের অভিভাবক নন, তিনি সম্রাট। কী করে বলেন, বেশ, আসুন তা হলে? আপত্তি করেন যুধিষ্ঠির। তখন এলেন ব্যাসদেব। বললেন, সম্মত হও, আর বিচারের প্রয়োজন নেই। ব্যস, সম্রাটেরও জোর খাটল না। ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী, কুন্তী, চিরবিদায় নিলেন প্রাসাদ থেকে। বনে গিয়ে প্রায়-উপবাসে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করবেন। রাজারও অধিকার নেই অর্থহীন, শান্তিহীন জীবন বাঁচতে বাধ্য করার।

Advertisement

যা নেই মহাভারতে, তা নেই ভারতে। কিন্তু মহাভারতে যা কিছু আছে, আজকের ভারতে তা কি আছে? আছে কি এমন কোনও কর্তৃত্বের সুর যা মনে করিয়ে দেয়, জীবন পূর্ণ হলে যেতে দেওয়াই কর্তব্য?

সম্প্রতি আমার কাকা চলে গেলেন। অবিবাহিত মানুষটি পার্কিনসন্সে আক্রান্ত হওয়ার পর ভ্রাতুষ্পুত্রীদের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন। এক এক করে সব ক্ষমতা লোপ পাচ্ছিল। চিন্তার স্বচ্ছতা ফিরে এলেই মুক্তির জন্য মিনতি করতেন। অর্থহীন সান্ত্বনা দেওয়া ছাড়া আর কী করার ছিল। পরিচিত এক বৃদ্ধ বলেছিলেন, ‘রোজ ভোরে উঠে বলি, ঠাকুর, যেন আর একটা ভোর দেখতে না হয়।’ এমন কত প্রার্থনা রোজ উচ্চারিত হচ্ছে, কে জানে?

Advertisement

রাষ্ট্র তেমন প্রার্থনা মঞ্জুর করে না, করতে দেয়ও না। একটা খবর এসেছিল উত্তর চব্বিশ পরগনা থেকে। একশো বছর পেরিয়ে এক গাঁধীবাদী স্বাধীনতা সংগ্রামী স্থির করেন, অনশন করবেন। না, কারও ওপর কোনও ক্ষোভ নেই। এত জীর্ণ দেহ ত্যাগ করাই কর্তব্য, বলেছিলেন পুত্রদের। এলাকায় সুপরিচিত মানুষটি আহার ত্যাগ করেছেন শুনেই ভিড় জমতে লাগল। গোলমাল বাড়তে শেষে এসডিও বৃদ্ধকে ভর্তি করালেন হাসপাতালে, নল দিয়ে খাওয়ানো হতে লাগল। আত্মহত্যাকে ‘অপরাধ’-এর কলঙ্ক থেকে মুক্ত করেছে আইন, কিন্তু পিতা-পিতৃব্যের অচিকিৎসায়, অনাহারে সম্মতি দেওয়া সন্তানের পক্ষে অপরাধ। মৃত্যু আর জীবনের স্বাভাবিক পরিণতি নেই। মৃত্যু এখন প্রতিপক্ষ, সর্বশক্তিতে তাকে প্রতিহত করাই আত্মীয়-পরিজনের ধর্ম। মৃত্যু সমাগত জেনে বিনা প্রতিরোধে তাকে মেনে নেওয়া কর্তব্যে অবহেলা, নির্দয়তা, কৃপণতার লক্ষণ। অকৃতজ্ঞ সন্তান। ওই দেখো, যে সারা জীবন ছেলেমেয়ের জন্য এত করল, এখন তাকেই...

আইন অবশ্য বলে, সজ্ঞানে যদি কেউ চিকিৎসা প্রত্যাখ্যান করেন, সে অধিকার তাঁর আছে। কিন্তু সে সময়-সুযোগ আর ক’জন পান, আর বৃদ্ধ মানুষটি ওষুধ খেতে না চাইলে তাঁর কথা শুনছেই বা কে। প্রায় সকলেই যন্ত্রণা কমাতে, রোগ বশে রাখতে কিছু না কিছু চিকিৎসা করাতে বাধ্য হন। এক দিন নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়ার সময় পেরিয়ে যায়। প্রশ্ন ওঠে, রোগীকে ভেন্টিলেশনে দেওয়া হবে কি না। এক বার দেওয়া হলে আর বের করা যাবে না। আইন লাইফ-সাপোর্ট খোলার অনুমতি দেয় না। যদি সেই জীবন্মৃত অবস্থায় ঠেলে না দিতে চান পিতা, পিতৃব্যকে? তা হলে সই করতে হবে ‘নো ইনকিউবেশন, নো ভেন্টিলেশন’ ফর্মে। প্রাণসংশয় হলেও কৃত্রিম শ্বাস শুরু করা যাবে না, এই মর্মে সই।

জীবনের কঠিনতম স্বাক্ষর। জীবন্মৃত আর মৃত, এই দুই তো এক নয়। মৃত্যুকে এড়ানোর প্রযুক্তি যখন আছে, তাকে অগ্রাহ্য করার অধিকার কে দিয়েছে? হতে পারে মানুষটি আচ্ছন্ন-চেতনা, অন্তর্হিত-স্মৃতি, বাক্যরহিত, শয্যাক্ষতে যন্ত্রণাবিদ্ধ। তবু তাঁর হয়ে তাঁর জীবন শেষ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার কি অধিকার আমার আছে? ‘ওয়েটিং’ ছবিটিতে (ছবিতে তার একটি দৃশ্য) নাসিরুদ্দিন শাহ ও কল্কি কেঁকলার চরিত্র দুটি সেই সিদ্ধান্তের সামনে। স্বামী জড়ভরত হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যেতে চাইতেন, কল্কির এই কথা শুনে ক্ষিপ্ত নাসিরুদ্দিন প্রশ্ন করেন, ‘কী করে তুমি জানলে?’ তিনি নিজে বাড়ি ডবল মর্টগেজ করেও বাঁচিয়ে রাখতে চান স্ত্রীকে, ডাক্তারদের পরামর্শও নাকচ করে দেন।

কেউ যদি নিজে ‘নো ভেন্টিলেশন’ নির্দেশ দিয়ে যান, পরিজনের নিষ্কৃতি। না হলে মনের মধ্যে হাতড়ে ফিরতে হবে, কোন শাস্ত্রগ্রন্থ, কোন ঋষিবাক্য, কোন নীতিকাহিনি থেকে ‘নো ভেন্টিলেশন’ সিদ্ধান্তের সমর্থন মেলে। আছে হয়তো কোথাও। কিংবা হয়তো নেই। আর থাকলেও মানতে হবে, এমন তো নয়। আজকাল কি কেউ অন্তর্জলি যাত্রা করে?

সাদা টালি, কড়া ফিনাইলের গন্ধ, নার্স ধরিয়ে দিয়েছেন দু’পাতার ফর্ম, বল পয়েন্ট পেন। পাশ থেকে ডাক্তারবাবু বললেন, ‘ভেন্টিলেশনে গেলে এ ধরনের রোগীদের এইটি পার্সেন্টই ফেরে না।’ সই করে দিলাম ‘নো ভেন্টিলেশন’ ফর্মে। তাঁদের ছিল ধর্ম-অধর্ম। আমাদের আছে কস্ট-বেনিফিট অ্যানালিসিস। তাঁদের ছিল ব্যাসবাক্য। আমাদের আছে ইনফর্মড চয়েস। ডাক্তার তথ্য দেবেন, সিদ্ধান্ত নেবে রোগী, পরিজন।

যখন ডাক্তারকে দাঁড়াতে হয় পরিজনের স্থানে, তখন তিনি টের পান যে রোগীর যা দরকার, তা শুধু তথ্য নয়। অতুল গওয়ান্ডে মার্কিন দেশের সার্জন, তাঁর বাবাও ডাক্তার। বাবার মেরুদণ্ডে টিউমার ধরা পড়ল, ছেলে নিয়ে গেলেন ক্যান্সার বিশেষজ্ঞের কাছে। বাবা অজস্র প্রশ্ন করছেন, উত্তর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞ। অতুল লিখছেন, ‘তিনি জানতেন, তিনি বাবার তথ্যের চাহিদা মেটাচ্ছেন না। বাবার ভয় মেটাচ্ছেন।’ রোগের চাইতেও বেশি বিপন্ন করবে চিকিৎসা, সেই ভয়। অতুলের ‘বিইং মর্টাল’ বইটির শেষ অধ্যায়: ‘সাহস’। রোগীর সঙ্গে এক কঠিন কথোপকথন শুরুর সাহস। দিন সীমিত, রোগী কেমন জীবন চান, তা পাওয়ার বিনিময়ে তিনি কী ঝুঁকি নিতে রাজি আছেন। কর্মময় জীবন চেয়েছিলেন অতুলের বাবা, তাই টিউমার বাড়তে পারে জেনেও তখনই অপারেশন করাননি। ব্যথা কমানোর চিকিৎসা চলেছিল তিন বছর।

তবে কাজটা কঠিন, বলছেন অতুলও। অতিবৃদ্ধ, অতি-অসুস্থ, অতি-দরিদ্রের সঙ্গে এমন সংলাপ সম্ভবই নয়। তখন চিকিৎসকই স্থির করেন, কী চিকিৎসা হবে। আর তাঁরা প্রাণ বাঁচানোকেই প্রাধান্য দেন। তাতেই আপত্তি অতুলের। জীবন দীর্ঘ করা চিকিৎসার উদ্দেশ্য নয়। প্রয়োজনে না-চিকিৎসার সাহস চাই।

সে সাহস ছিল জীবন মশায়ের। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরোগ্য নিকেতন’ উপন্যাসে এক অতি-বৃদ্ধার নাড়ি ধরে প্রাচীন কবিরাজ বলছেন, ‘তিন মাস থেকে ছ’মাস, তার মধ্যে মুক্তি পাবেন আপনি। তবে এ কালের ওষুধ খেলে হয়তো আরও কিছু দিন দুর্ভোগ ভোগ করতে হবে। এ কালের ওষুধ বড় শক্তিশালী।’ ওষুধের গুণেই আমার কাকাকে ভেন্টিলেশনে দিতে হয়নি। ফিরেছেন বাড়িতে। মুখে খাওয়ার দিন শেষ, নাকে টিউব। ফের লড়াই, সংক্রমণ, প্যারালিসিস, বেড সোর-এর সঙ্গে। আরও কড়া অ্যান্টিবায়োটিক, আরও ঘন ঘন ড্রেসিং, আরও বেশি সাকশান করে কফ তোলা।

তাঁর বোবা কষ্ট দেখে মনে পড়ত, জীবন মশায় ভয়ার্ত দাঁতু ঘোষালকে সাহস দিচ্ছেন, ‘এই ভাঙা জরা দেহ — এ নিয়ে করবি কী? পালটে ফেল, পালটে ফেল।’ পরিসংখ্যান-নির্ভর, সাক্ষ্যপ্রমাণ-ভিত্তিক সিদ্ধান্তে চিকিৎসার মডেল তাঁর নয়। শাস্ত্রবাক্য মনে করিয়ে মৃত্যুকে সহনীয়, এমনকী প্রার্থনীয় করে দেখাচ্ছেন চিকিৎসক। সে জন্য সে যুগেও তিরস্কৃত হয়েছিলেন জীবন মশায়। বুঝেছিলেন, তাঁর চিকিৎসা, তাঁর জীবনদর্শন বাতিল হয়েছে। কিন্তু তাঁর স্থানটি নিল কে? কোন নৈতিক যুক্তি, কোন দর্শন, কোন ধর্মবিচার দিয়ে চিন্তা করব, ভাল মৃত্যু কেমন মৃত্যু, মন্দ মৃত্যুই বা কেমন। চিকিৎসার সীমা দিয়ে মৃত্যু নির্ণয় না করে, প্রার্থিত মৃত্যু দিয়ে চিকিৎসার সীমা নির্ণয় করা উচিত কি না।

শেষ অবধি নিজের বিছানাতেই প্রায় নিঃসাড়ে এক ভোরে কাকা চলে গেলেন। সবাই সান্ত্বনা দিলেন, যথেষ্ট করেছ। তাই কি? ‘যথেষ্ট’ কথাটার মানে ‘ইষ্টকে অতিক্রম না করিয়া।’ অকারণ চিকিৎসায় যন্ত্রণা দীর্ঘায়িত করে ইষ্ট অতিক্রম করিনি কি? কৃপণ গৃহস্থ যেমন ভিখারিকে দাঁড় করিয়ে রাখে, নিষ্কৃতি-প্রার্থী মানুষটিকে তেমন করে প্রতীক্ষা করাইনি কি? এই দুর্বলতা, কাপুরুষতা কি পাপ নয়? পাপ বইকি। তার প্রায়শ্চিত্ত করে যেতে হবে। সন্তানেরা আমাদের দেখেই তো শিখছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement