ডাচ প্রধানমন্ত্রী মার্ক রাটল।
গত ২ ফেব্রুয়ারি নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী মার্ক রাটল (ছবিতে) এক ঐতিহাসিক কাজ করলেন। হলোকস্টের পঁচাত্তর বছর পর নাৎসি গণহত্যার শিকার পরিবারের কাছে নিজের দেশের তৎকালীন প্রশাসনের ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাইলেন। বার্ষিক স্মরণ অনুষ্ঠানে আমস্টার্ডামের হলোকস্ট স্মারকের সামনে দাঁড়িয়ে মার্ক বললেন, “সেই গণহত্যার সময়ে প্রাণরক্ষা করতে পেরেছেন এমন মানুষ এখনও আমাদের মধ্যে আছেন। আমি সরকারের তরফ থেকে সব কিছুর জন্য ক্ষমা চাইছি, কর্তৃপক্ষ এক সময় যা করেছেন।” আরও বলেছেন, “আমাদের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলি তখন সুবিচার দান ও নিরাপত্তা রক্ষার কাজ করেনি। বরং অনেক সরকারি কর্মীই দখলদারদের হুকুম তামিল করেছেন।”
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি কবলে থাকা নেদারল্যান্ডসে এক লক্ষের বেশি ওলন্দাজ-ইহুদির হত্যা বা নির্বাসন আটকাতে সে দেশে দায়িত্বে থাকা সরকারি কর্মীরা যা করতে পারতেন, তা করেননি। বরং দেশের সাধারণ নাগরিক জার্মান শাসকদের অপকীর্তির প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। কিন্তু বিরাট এক অন্যায়ের মুখোমুখি দাঁড়ানোর মতো শক্তি সেই ক্ষুব্ধ জনতা অর্জন করতে পারেননি। প্রধানমন্ত্রীর ভাষায়, “তাঁদের নিরাপত্তা বলতে প্রায় কিছুই ছিল না। সাহায্য বা স্বীকৃতিও তাই।” গত বছর ‘ডাচ ন্যাশনাল রেলওয়ে কোম্পানি’ও সেই সব ইহুদি বা তাঁদের পরিবারের সদস্যকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে, যাঁরা তাঁদের ট্রেনে চড়ে এক বার হারিয়ে যাওয়ার পথে পা বাড়িয়ে আর কখনও ঘরে ফেরেননি। প্রথমে সেই দুর্ভাগা মানুষদের ‘ট্রানজ়িট ক্যাম্প’-এ আনা হত। তার পর চালান দেওয়া হত আউশভিৎসের মতো কনসেনট্রেশন ক্যাম্প বা ডেথ ক্যাম্পে। আর তাঁদের ফেরার ট্রেন ধরা হত না। কিশোরী আনে ফ্রাঙ্ককেও প্রথমে একটি ‘ট্রানজ়িট ক্যাম্প’-এই রাখা হয়েছিল। জার্মানদের তত্ত্বাবধানে সেই সব ট্রেন যে লাইন দিয়ে চালানো হত, রেলওয়ে কর্মচারীরা সেই লাইনের উপর গোলাপ রেখে ক্ষমা চেয়েছিলেন। এর আগে ফ্রান্সের রেল কোম্পানিও ইহুদিদের প্রতি অবিচারের জন্য ক্ষমা চেয়েছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রথম দিকে নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে জার্মানির ‘নিরপেক্ষতার চুক্তি’ ছিল। ১৯৪০ সালে প্রবল বোমাবর্ষণের মধ্যে দিয়ে জার্মানি সেই চুক্তি ভঙ্গ করে, দেশটির দখল নেয়। নেদারল্যান্ডসের ক্ষমতা ছিল না হিটলারের বিরুদ্ধে সামরিক প্রতিরোধ বেশি সময় টিকিয়ে রাখার। দেশে নাৎসি অধিকার কায়েম হতেই রাজপরিবার দেশ ছেড়ে পালায়। সাধারণ মানুষ, বিশেষত ইহুদিদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করার অবকাশ দেশের বিপন্ন সরকারের ছিল না। নাৎসিরা কিন্তু নেদারল্যান্ডসের জনতার উপর প্রথমেই অত্যাচার নামিয়ে আনেনি। এক অসামরিক শাসক নিযুক্ত করে ‘ভেলভেট গ্লাভ’ নীতিতে দেশ চালানো হয় বছরখানেক। হিটলার তো নেদারল্যান্ডসবাসীকে ‘নাৎসি ভাই’ হিসেবে দেখতে থাকেন। আপাতনরম সেই মুখোশ ধীরে ধীরে খুলে পড়তে লাগল কিছু দিনের মধ্যেই। ইহুদি-বিরোধী আইন আসতে লাগল, তাঁদের চাকরি কেড়ে নেওয়া হল। নেদারল্যান্ডসের জনতা সহজে মেনে নেননি। অধ্যাপক, ছাত্র, ধর্মযাজক-সহ বহু মানুষ প্রতিবাদ, ধর্মঘট ইত্যাদিতে শামিল হন। কোনও ফল হয়নি। ১৯৪২ সাল থেকেই ইহুদিদের নির্বাসনে পাঠানো শুরু হয়। যুদ্ধের আগে ওলন্দাজ-ইহুদির সংখ্যা ছিল প্রায় দেড় লক্ষ। যুদ্ধশেষে মাত্র আটত্রিশ হাজার ইহুদি প্রাণে বেঁচে ছিলেন।
শুধু নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স বা বেলজিয়াম নয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসিদের হাতে নির্যাতিত এবং খুন হওয়া ইহুদি ও সংখ্যালঘু মানুষের সংখ্যা আরও অনেক দেশের ইতিহাসকে অশ্রুসজল করে তুলেছিল। সেই সব অতীত নারকীয়তাকে আর বদলানো সম্ভব নয়। প্রশ্ন হল, আজকের পৃথিবী তাকে কী চোখে দেখবে। এও প্রশ্ন যে, ইতিহাসে ঘটে-যাওয়া কত রকম দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা, ক্ষমা ভিক্ষার কি শেষ আছে কোনও? না কি, রাষ্ট্রের তরফে পরিচালিত অন্যায়ের জন্য কখনও না কখনও রাষ্ট্রের ক্ষমা ভিক্ষা করা জরুরি?
এই সব ক্ষমা প্রার্থনার দৃষ্টান্ত শুধুমাত্র প্রতীকী হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা সত্ত্বেও প্রচেষ্টাগুলির পিছনে সৎ আবেগটিকে সাধুবাদ না জানিয়ে উপায় নেই। হিরোশিমায় বোমা ফেলেছিল যারা, জালিয়ানওয়ালা বাগে অসহায় মানুষকে মেরেছিল যারা, মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা করেছিল যারা, লক্ষ লক্ষ মানুষকে দেশছাড়া করে উদ্বাস্তু বানিয়ে দিচ্ছে যারা, তাদের মুখে ‘ক্ষমা চাওয়া’র মতো শব্দবন্ধ শোনার অপেক্ষায় আছি আমরা। অসময়ে, অবর্ণনীয় যন্ত্রণার মধ্যে যখন কাউকে আমরা ঠেলে দিই, নিজেকে তার জায়গায় বসিয়ে অনুভব করতে পারি না সেই অন্যায়ের মাপ। তাই, আজ বা কাল, বর্তমানে বা ভবিষ্যতে, অন্যায় স্বীকারের মধ্যে যে পাপক্ষালনের সুযোগ, তা গ্রহণ করাই ধর্ম।