পতখন সন্ধ্যাবেলা। রান্নাঘরে বসে উলের গোছা জড়িয়ে তিনি বল বানাচ্ছেন। পাশে রাখা রেডিও। রোজকার মতো তাতে সান্ধ্য খবর হচ্ছে। ঘরের অন্য কোণে তার মা আর বোন। তারা কী যেন একটা করছেন। হঠাৎ শোনা গেল, রেডিওতে বলছে — ইণ্ডিয়ান কুইসলিং সুভাষচন্দ্র বোস তাইহোকুতে বিমান দুর্ঘটনায় নিহত।
মা আর বোন স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। আর যিনি উলের বল বানাচ্ছিলেন, ধীর পায়ে উঠে গিয়ে শোবার ঘরে ঢুকলেন। চোখে তাঁর জল। সেখানে শোয়ানো ছোট্ট মেয়ের সামনে হাঁটু মুড়ে বসে পড়লেন। আবেগের সমস্ত আগল যেন এ বার ভেঙে গেল। অঝোরে কেঁদেই চললেন তিনি, এমিলিয়ে শেঙ্খেল। সুভাষচন্দ্র বসু’র স্ত্রী।
১৯৩৪ থেকে ১৯৪২ পর্যন্ত এমিলিয়েকে মোট ১৬২ খানা চিঠি লিখেছিলেন সুভাষ। রোম থেকে পাঠানো এক চিঠিতে যদিও তিনি দাবী করেছিলেন— ‘চিঠিপত্র লেখায় আমি বেশ অনিয়মিত, তবে মানুষ হিসেবে আশা করি আমি খুব খারাপ নই।’ তবু এমিলিয়ের সাথে যোগাযোগ রক্ষায় তিনি যে নিরসল, তা চিঠির সংখ্যা দেখে বুঝে নিতে কারও অসুবিধা হওয়ার নয়।
স্বাধীনতা সংগ্রামী সুভাষচন্দ্র বড় রাজনীতিক হলেও ব্যক্তি সুভাষ কম বড় মানবিক নন। তার প্রমাণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে তাঁর চিঠিপত্রের ছত্রে ছত্রে। কত জায়গা থেকেই না তিনি এমিলিয়েকে চিঠি লিখেছেন— কখনও জেলখানা থেকে, কখনও বা বন্দিগৃহ থেকে, কখনও আবার চূড়ান্ত রাজনৈতিক অগ্নিকুণ্ডের মধ্য থেকেই। এ সব চিঠিপত্র সুভাষচন্দ্রের মানবিক মুখ। কঠিন সময়েও কাছের মানুষদের কখনও তিনি বিস্মৃত হননি। ১৯৪১ সালে জার্মানিতে সুভাষ-এমিলিয়ে নিজেদের গাঁথলেন স্থায়ী সম্পর্কের সূত্রে। শুধু এমিলিয়েই নন, যাঁরাই সুভাষচন্দ্রের কাছে এসেছেন, তাঁরাই তাঁর আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়েছেন, তা সে কাছের মানুষই হোক বা দূরের। কলকাতায় এলগিন রোডের বাড়িতে এ রকমই এক অপরিচিত যুবক সুনীল ঘোষ মৌলিকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল সুভাষচন্দ্রের। মুর্শিদাবাদের পাঁচথুপির ছেলে সুনীল তখন কলকাতার স্কটিশচার্চ কলেজের ছাত্র। ছাত্রাবস্তাতেই রাজনীতিতে তাঁর হাতেখড়ি। উনিশ-কুড়ি বছর বয়সের মধ্যেই কংগ্রেস প্রাদেশিক কমিটির সদস্য। সেই সূত্রে শরৎ বসু-র সঙ্গে যোগাযোগ। তারই অনুরোধে সুভাষচন্দ্রের কান্দি সাব-ডিভিশনের পাঁচথুপি গ্রামে আসা। কংগ্রেসের দলীয় কাজে সে বার তিনি মুর্শিদাবাদে। এটা ১৯২৯ সালের কথা। কাজ হয়ে গেলে পাঁচথুপিতে সুনীল ঘোষ মৌলিকের বাড়ি যান। দূরের মানুষকে কাছের করে নিয়েছিলেন এক বিকেলেই। প্রত্যক্ষ যোগাযোগ বেশী না হলেও উভয়েই শীঘ্রই পত্র-সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। সেখানেও সুভাষের মানবিক রূপ স্পষ্ট। যখনই সুনীলবাবু চিঠি দিয়েছেন, প্রত্যুত্তর দিয়েছেন সুভাষচন্দ্র। জানতে চেয়েছেন মুর্শিদাবাদের খবরাখবর। নিয়েছেন গ্রামের সংবাদ। দূরের বন্ধু বলে অবহেলা করেননি কখনও। এতটাই আন্তরিক।
এই সুনীল ঘোষ মৌলিক যখন বিয়ে করলেন, সুভাষচন্দ্র তাঁকে এক চিঠি পাঠিয়েছিলেন। সেখানে বৈবাহিক সম্পর্ক যে তাঁর কাছে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ, তা জনলে অবাক হতে হয়। যদিও ব্যক্তি-জীবন, পারিবারিক জীবন তার কাছে মূল্যহীন ঠেকে যদি না তা দেশকল্যাণে লাগে। ব্যাজাস্টাইন থেকে ১৯৩৬-এর ১৭ই মার্চের সেই চিঠিতে সুভাষচন্দ্র লিখছেন —
কুরহ্যাং,
ব্যাজাস্টাইন,অস্ট্রিয়া।
প্রীতিভাজেনেষু,
১৭/৩/৩৬
তোমার ২২শে জানুয়ারির চিঠি যথাসময়ে পেয়েছিলাম, কিন্তু নানা দেশে ঘুরছিলাম বলে সময় মত উত্তর দিতে পারি নাই। এখন এত বিলম্ব হয়ে গেছে যে ভাবছিলাম আর লিখে কি হবে। শেষে লেখাই স্থির করলাম।
এত দিনে তোমার শুভ বিবাহ হয়ে গেছে। এরূপ ঘটনা মানুষের জীবনে এক বারই হয় এবং এই ঘটনার উপর ভবিষ্যতের ভালোমন্দ অনেক কিছু নির্ভর করে। তাই আমি প্রার্থণা করি তোমার বিবাহিত জীবন সুখময় হউক এবং দেশের ও দশের হিতার্থে তোমাদের জীবন ব্যয়িত হোক। ব্যক্তিগত বা পরিবারগত সুখের মূল্য আমার কাছে মোটেই নাই যদি ব্যক্তি এবং পরিবারবর্গের জীবন দেশের কল্যাণে নিয়োজিত না হয়, তাই আমি বিশেষ করিয়া প্রার্থণা করি যেন তোমাদের জীবন দেশের ও দশের কল্যাণে ব্যয়িত হয়। তারমধ্যেই শ্রেষ্ঠ সুখ আনন্দের আস্বাদ নিশ্চয় পাবে।
তোমার সঙ্গে কবে আবার দেখা হবে জানি না— তাই খুব দূর থেকে এই শুভ ইচ্ছা তোমার কাছে পাঠাচ্ছি। আমার ভালোবাসা জানবে।
ইতি
শুভার্থী
শ্রীসুভাষচন্দ্র বসু
নেতাজি আমাদের কাছ থেকে হারিয়ে গিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু পেছনে ফেলে গেছেন তার আন্তরিকতা, মানবিকতা আর দেশ কল্যাণের মহান আদর্শ। আজ হিংসা-দ্বেষ দীর্ণ সমাজে তাই তাঁর দৃষ্টান্ত বিশেষভাবে অনুসরণযোগ্য।
শিক্ষক, মহাদেবানন্দ মহাবিদ্যালয়