নরেন্দ্র মোদী যখন ক্ষমতাসীন হন, তখন সমগ্র দেশ জুড়ে এমন এক প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল যে এ বার সম্ভবত দেশে সরকারি নিয়ন্ত্রণ কমবে, ভারতীয় শাসনব্যবস্থায় নাগরিক সমাজের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। বিজেপির স্লোগান ছিল, ‘ম্যাক্সিমাম গভার্নেন্স, মিনিমাম গভার্নমেন্ট।’ অতএব প্রশাসনিকতায় রাষ্ট্রীয় লাল ফিতের নিয়ন্ত্রণ মুক্তি ঘটবে, শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠন সম্ভব হবে সংস্কারমুখী খোলা বাজারের হাওয়ায়।
দু’বছর হব হব করছে মোদী সরকারের। আমরা কী দেখছি? দেখতে পাচ্ছি গোটা দেশ জুড়ে উগ্র জাতীয়তাবাদের নামে শুরু হয়েছে এক চূড়ান্ত রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ। সরকারি প্রশাসন প্রতিটি ছোট ছোট বিষয়েও সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিচ্ছে। নাগরিক সমাজ সেই একমুখী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে মুখরিত হলেও সরকার আরও অনমনীয় হয়ে ওঠে, সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার তো দূরের কথা, রাষ্ট্রযন্ত্র চিৎকার করে বলতে থাকে, যা করেছি বেশ করেছি, করবই তো।
পুণে ফিল্ম ইনস্টিটিউটের অধিকর্তা নিয়োগই হোক, আর কানহাইয়ার বিরুদ্ধে জেএনইউ ক্যাম্পাসে ঢুকে পুলিশি হামলার ঘটনা— সব বিষয়েই সরকারের একমুখী এক দুর্বিনীত ছবি ফুটে উঠেছে। আলাপ-আলোচনার চেয়ে এখানে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতাই বেশি।
কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে বলেছিলেন, রাজা সেই সিদ্ধান্ত নেবেন যাতে প্রজার কল্যাণ হবে। প্রজারাও মনে করবেন তাতে প্রজাদের কল্যাণ। রাজা মনে করছেন কল্যাণ হবে, অথচ প্রজারা মনে করছেন, না, এমন সিদ্ধান্ত নিলে চলবে না। নরেন্দ্র মোদী ২৮২টি আসন পেয়ে শক্তিশালী রাজনেতা হয়েছেন এ কথা সত্য। সংখ্যাগরিষ্ঠতার সরকারের অধিকার আছে সিদ্ধান্তগ্রহণের। মন্ত্রিসভায় নীতি প্রণয়নের ক্ষমতা থেকে রাজ্যপাল বা সচিব নিয়োগের জন্য নিশ্চয়ই বার বার প্রত্যক্ষ গণভোটের প্রয়োজন হয় না। নির্বাচনে জয়লাভের পরে সেটাই অপ্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের রূপ। মনমোহন সিংহের জমানায় নীতিগ্রহণে পঙ্গুতা ছিল এক মস্ত বড় অভিযোগ। কিন্তু এ কথাও সত্য, সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে দেশ শাসনের জন্য। কিন্তু প্রতি দিন সরকারকে এক অদৃশ্য মতৈক্য রচনার প্রক্রিয়া গ্রহণ করেই চলতে হয়। প্লেটোর রাষ্ট্র ভাবনায় সরকার-সমাজ-ব্যক্তি নাগরিক এই ধারণাগুলির ভিন্নতা ছিল না। দার্শনিক ভাবে এ সবই রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল। যাকে রাজনীতি বিজ্ঞানের পিতা বলা হয় সেই অ্যারিস্টটল কিন্তু কার্যত গুরুর ভাবনাকেই চ্যালেঞ্জ করে বুঝিয়ে ছিলেন সরকার ও নাগরিক সমাজের সঙ্গেও রাষ্ট্রের আকারগত পার্থক্যরেখা আছে। পৃথিবীর ইতিহাসে কখনও স্তালিন, কখনও হিটলার এক অখণ্ড জাতীয়তাবাদের জিগির তুলে সেই বিভাজনরেখাকে অবলুপ্ত করতে চেয়েছেন। কিন্তু বাস্তবে তা দীর্ঘস্থায়ী সফলতা অর্জন করেনি।
ভারত এক বহুত্ববাদী বহুমাত্রিক দেশ। নানা ভাষা নানা মত, নানা পরিধানের দেশ। ধর্ম, জাতপাত, আর্থিক অবস্থান ও সাংস্কৃতিক বিভিন্নতার মতো নানা বিবিধের মাঝে এ দেশ মিলনের চেষ্টা চালিয়েছে সভ্যতার আদি লগ্ন থেকে। সম্রাট অশোক থেকে আকবর। তার পর ’৪৭ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পরবর্তী ভারতেও এই বিভিন্নতার অখণ্ডতা রক্ষিত হয়েছে।
অতীতে এই বহুত্ববাদের মধ্যে অসহিষ্ণুতা ছিল না এমন নয়। বিবিধের মাঝে মহান মিলন দেখার মধ্যেও অতিসরলীকরণ ছিল। তাই রজনী কোঠারিদের মতো তাত্ত্বিকদের ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে মার্কসবাদী সুদীপ্ত কবিরাজরা বলার চেষ্টা করেছেন যে ভারত বহু সংস্কৃতির দেশ হলেও, অভ্যন্তরীণ সংঘাতগুলি ঘুচিয়ে সুষম সংস্কৃতির দেশ হয়ে উঠতে পারেনি। যেমন আমেরিকার কালো জনসমাজ বা ইহুদিরা বসবাস করলেও তারা সমসত্ত একক সমাজে পরিণত হতে পারে না।
খণ্ড জাতীয়তার ধারণাগুলিকে স্টিমরোলার দিয়ে নির্মম ভাবে একদম সোজা করে দেওয়ার চেষ্টা করলে বরং প্রান্তসত্তার বিভিন্নতা বাড়ে, তা হিন্দিবিরোধী তামিল ভাষার আন্দোলনই হোক আর কাশ্মীর বা উত্তর-পূর্বের বিচ্ছিন্নতাই হোক। অখণ্ড জাতীয়তাবাদকে বরং বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হয় অনেক বেশি, যদি প্রান্তসত্তাকেও বাঁচিয়ে রাখা যায়।
বিজেপির পুরনো হিন্দু জাতীয়তাবাদকে শক্তিশালী স্বনির্ভর রাষ্ট্র গঠনের প্রত্যাশার সঙ্গে যুক্ত করে নরেন্দ্র মোদী মেক ইন ইন্ডিয়া-র একটা প্যাকেজ তৈরি করেছিলেন। কিন্তু দু’বছর দেশ শাসনের পর এখন মনে হচ্ছে সেই শক্তিশালী জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রগঠনের প্রচেষ্টায় ব্যক্তি ও নাগরিক সমাজের স্বাধীনতা খর্ব হচ্ছে। সরকারি প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ এক নতুন রাষ্ট্রবাদ বা ‘স্টেটইজম’ নিয়ে আসছে যা প্রকৃত পুঁজিবাদী। উদারবাদেরও বিরোধী। আদর্শ পুঁজিবাদ যেমন বাজার উন্মুক্ত করার কথা বলে। সে ভাবে, তাতে ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রসার ঘটে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র ও সরকার ক্রমশ তার বৃহৎ দাপট হারায়, ব্যক্তি ও সমাজ আপেক্ষিক গুরুত্ব অর্জন করে। বেসরকারিকরণ ও আর্থিক সংস্কারও রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ শক্তিকে খর্ব করে।
এখানে একটা প্রশ্ন ওঠে। নরেন্দ্র মোদী তো ভোটের আগে দুর্বলতা কাটিয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠনের কথাও বলেছিলেন। আরএসএস তথা বিজেপির সাবেক হিন্দু জাতীয়তাবাদও অখণ্ড ভারত নামক শক্তিশালী রাষ্ট্র ভাবনার স্বপ্ন দেখে। অতীতে ভারতেও শক্তিশালী রাষ্ট্রের গৌরব গাথা তুলে ধরে জাতীয়তাবাদ এবং দেশাত্মবোধের ভাবনাকে উসকে দেওয়া হয়েছে। নরেন্দ্র মোদী এ বার সাবেক হিন্দু রাষ্ট্রের কথা সরাসরি না বললেও ‘সফ্ট স্টেট’-এর অভিযোগকে ধূলিসাৎ করে জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন গ্রহণের জন্য শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন ভারতবাসীর কাছে বিক্রি করে দিলেন। এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে, রাষ্ট্র ও সরকারের নিয়ন্ত্রণ কমিয়ে প্রকৃত সুশাসনের স্লোগানের সঙ্গে সেই শক্তিশালী জাতি-রাষ্ট্র গঠনের ভাবনা কি স্ববিরোধী নয়?
হিটলার এবং স্তালিন দু’জনেই মতাদর্শগত ভাবে দুই ভিন্ন মেরুর বাসিন্দা হলেও, দু’জনেই কিন্তু জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠনের কথা বলেন। ভুলে যাওয়া যায় না হিটলারের দলটির নামও ছিল, জাতীয় সমাজতন্ত্রী দল। হায়দরাবাদ এবং জেএনইউ, দুই সাম্প্রতিক ঘটনার পর তো জাতীয়তাবাদ ও দেশাত্মবোধ নিয়ে তীব্র বিতর্ক শুরু হয়ে গিয়েছে দেশ জুড়ে। এ ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সমাজের জাতি-সত্তার ভিত্তিতে শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠনের উদ্দেশ্যে আবার সামনে উঠে এসেছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আবার প্রশ্ন উঠেছে, ভারতের মতো বিশাল বহুত্ববাদী দেশে খণ্ড জাতীয়তাকে নিষ্পেষিত না করে তাকেও সঙ্গে নিয়ে চললেই কি অখণ্ডতা রক্ষা সহজ হয় না? যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় রাজ্যগুলির স্বাধিকার বাড়িয়ে প্রান্তিক জাতিসত্তাকে মর্যাদা দিয়েই কি গণতন্ত্র বেশি সুরক্ষিত হবে না? আর তা না করলে ধর্ম ও জাতিভিত্তিক মেরুকরণ বৃদ্ধি পেলে কি তাতে ‘লেস গর্ভমেন্ট ও মোর গভর্নেন্স’-এর স্লোগানটিও সম্পূর্ণ অবাস্তব অকেজো স্লোগান সর্বস্বতাতেই পরিণত হবে না? ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের সংঘাত বাড়িয়ে কি জাতীয়তাবাদকে সফল করা সম্ভব? না সে জাতীয়তাবাদ আমাদের প্রয়োজন? সিপিএমের দীর্ঘ ৩৪ বছরের শাসনেও এক ধরনের ‘সরকারবাদ’ বা ‘গভর্মেন্টালিজম’ তৈরি হয়, সে ধাঁচার প্রধান স্তম্ভ ছিল এক ধরনের ‘কেরানি কমিউনিজম।’ মতাদর্শের নামে এক ধরনের দলতন্ত্রের ক্ষমতা। উপাচার্য নিয়োগ থেকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের প্রধান ঠিক করেছে আলিমুদ্দিন স্ট্রিট। কিন্তু সেটা ছিল দলতন্ত্র নির্ভর— সরকারবাদ। এই সরকার সর্বস্বতার মনোভাব থেকেও একনায়কতন্ত্রের যাত্রাপথ শুরু হয়। অবলুপ্ত হয় নাগরিকের ব্যক্তিগত স্বাধীনতার পরিসর।
দু’বছরের মধ্যে শাহি দিল্লিতেও এই একদেশদর্শী কেন্দ্রিভূত ক্ষমতা সর্বস্বতার ছবি ফুটে উঠেছে চোখের সামনে। এই মানসিকতার পরিবর্তন খুব জরুরি। এই মানসিকতা বদল না হলে শেষের সে দিন ভয়ঙ্কর হবে।