এমন দেশটি। শ্রীনগরের রাস্তায়, দৈনন্দিনতা। অক্টোবর, ২০০৮। গেটি ইমেজেস
স্বপ্নে দেখলাম, তিহাড় জেলের ছোট্ট চাপা বদ্ধ ঘরের ‘সলিটারি’ কুঠুরি। পাশাপাশি দুই কুঠুরিতে দুই চেনা লোক, রবীন্দ্রনাথ আর মাইকেল মধুসূদন। রবীন্দ্রনাথ জাতীয়তাবাদের বিপদ আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে কী-সব লিখে বসে আছেন, তা-ও আবার ফেসবুকে নয়, ছাপানো বইয়ে! মাইকেলের অবস্থা আরও গোলমেলে, একে সংখ্যালঘু, তায় আবার রামকে ভিলেন আর রাবণের ছেলেকে হিরো বানিয়ে ছড়া কেটেছেন! তাঁর থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই না কি মহিষাসুর বন্দনায় জোয়ার এসেছে! দেশদ্রোহের তদন্তে প্রথমেই ধরা পড়েছেন এই দুই অ্যান্টিন্যাশনাল ‘সিক-উলার’। আর, প্ররোচনামূলক বক্তব্যের জন্য শ্রীঅরবিন্দের উদ্দেশে জারি হয়েছে লুকআউট নোিটস।
প্রবল অশান্তির ঘুম, বোঝাই যাচ্ছে। তাই আর একটা মুখ স্বপ্নের মধ্যেই হানা দিয়ে উঠল। নতুন-ওঠা গোঁফদাড়ির এই সুকুমার মুখটা দেখেছিলাম ঠিক এক বছর আগে, মার্চে, কাশ্মীরে। ঘোর শীতে বরফঘেরা ডাল লেকে আমাদের শিকারা চালাচ্ছিল সেই বছর কুড়ির ছেলে, গান গাইতে গাইতে। হঠাৎ পাশ দিয়ে চলে যাওয়া শিকারার চালকের সঙ্গে আমাদের এই ছেলেটিকে স্পষ্ট, সুন্দর ইংেরজিতে কথা বলতে শুনে অবাক হলাম। আলাপে জানলাম, দু’জনেই শ্রীনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরাজি সাহিত্যের স্নাতক ছাত্র, শীতের সময় চার মাস ক্লাস বন্ধ, শিকারা চালিয়ে হাতখরচা তোলে। পরে কী করতে চায়, জানতে চাইলে ভারী করুণ হেসে বলল, কী আর করবে, এ ভাবেই চলবে, ‘আপনাদের ইন্ডিয়ায় আমাদের তো কেউ কাজ দেয় না, থাকতেও দেয় না।’ ব্যস, এই ভাবেই? সারা জীবন? বেড়ানোর চার দিন সঙ্গে যে গাড়িটা ছিল, তার চালক বরফঝড়ের মধ্যে কোনওক্রমে এয়ারপোর্ট-এ পৌঁছে দিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে উর্দুতে বলল, আবার আসবেন কিন্তু, এতেই আমাদের যেটুকু যা চলে।
দু’মাস পরে আবার গেলাম। শীত শেষ, চিনার গাছে পাতার শামিয়ানা, চেনা তুষার-শহর সবুজে ঝকঝকে। কিন্তু জীবনের ছবিতে কোনও বদল নেই, সেই প্রতি রাস্তায় দু’পা অন্তর বন্দুক তাক করে দাঁড়িয়ে সেনাবাহিনী। বিচিত্র দম-আটকানো জীবন, উদ্ধত বেয়নেটের সামনে মানুষ রোজ স্কুলকলেজ যাচ্ছে, বাজার করছে, ভালবাসছে, কবরেও চলে যাচ্ছে। স্বাধীন ভারতের সুন্দরতম অঞ্চলটিতে কী অদ্ভুত দারিদ্র, হতশ্রী বাড়িঘর, ভাঙাচোরা কলেজ-হাসপাতাল, অনুপস্থিত নাগরিক জীবন, দুরবিন দিয়ে খুঁজতে হওয়া কাজের সুযোগ। তবুও এদের কেন ভারতকেই নিজের দেশ মনে করা উচিত, উত্তরটা মনে মনে খোঁজার চেষ্টা করছিলাম, আজও করছি। তাই জন্যই নিশ্চয় রবীন্দ্রনাথ-মাইকেলের পাশে স্বপ্নমোহে ঘাই দিয়ে উঠল মনে অশান্তি-জাগিয়ে রাখা সেই পাপহীন কাশ্মীরি মুখটা।
দূর থেকে শোনা এক, কাছে গিয়ে জানা আর এক। ওই ছেলেগুলি বাঁচার প্রতিটি মুহূর্ত বন্দুকের নলের সামনে কাটিয়েও ভারতের জয়গান গাইতেই বাধ্য, ভাবতে অবাক লেগেছিল। দেশ জুড়ে যদি সমীক্ষা হয় কত জন তাঁদের বাড়িতে এক জন কাশ্মীরি মুসলমানকে ভাড়াটে হিসেবে থাকতে দেবেন, তাতে যদি লজ্জায় মুখ লুকোতে হয়, তা হলেও মেরা ভারত তো মহান-ই। কেবল কাশ্মীর কেন, মণিপুরে দেখেছি অপরূপ লোকতাক হ্রদ আর আজাদ হিন্দ ফৌজের ইতিহাস নিয়ে পূর্বপ্রান্তের জনপদ মৈরাঙ-এও অবজ্ঞার ঠিক একই রূপ, কয়েক দশক-জোড়া অর্থনৈতিক শূন্যতা, একটিমাত্র এ.টি.এম থেকে টাকা তুলতে দুশো লোকের লাইন, অথচ সেনাবাহিনী যেন ফোটা ফুলের মতো ছড়িয়ে আছে যত দূর চোখ যায়। তবুও ওখানকার মানুষেরও গর্বিত, প্রশ্নহীন ভারতীয় হতেই হবে।
স্বপ্নের মধ্যেই টের পেয়েছি, আসল ব্যাপারটা অন্য। বিরিঞ্চিবাবার কথায়, সবই আপেক্ষিক কিনা! ক্ষুদিরাম বা সূর্য সেন মুক্তির লক্ষ্যে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলন করে ফাঁসিতে যান, সেটা আমাদের লোকগাথা। পাকিস্তান রাষ্ট্রের থেকে পুূবের বাংলার মানুষ যখন পরিত্রাণ চায়, আমরা সর্বশক্তি দিয়ে বাংলাদেশ গড়তে ঝাঁপাই: সে হল মুক্তিযুদ্ধ। চিনা রাষ্ট্রের সঙ্গে তিব্বতিদের স্বশাসনের লড়াই-এ আমরা সঙ্গে থাকি, কেননা আমরা স্বশাসনের পক্ষে। এমনকী নাগা আন্দোলনের পুরোধাদের সঙ্গে ঢাকঢোল পিটিয়ে সমঝোতা চুক্তিতেও আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু কাশ্মীর? কাশ্মীরিদের মুক্তি বা স্বশাসন ইত্যাদি মুখে আনামাত্র নখ, দাঁত বার করাটাই জাতীয়তাবাদ, ভারতীয়তাবাদ।
আর, কে না জানে, দেশপ্রেমের সেটাই সংজ্ঞা যেটা ‘আমি’ ভাবব। এ আমার, আমাদের দেবোত্তর সম্পত্তি। বেচাল দেখলেই পিটুনি, ধোলাই। হাতে হাত ধরে বেঁধে বেঁধে থাকার দুঃসাহস? ক্ষমতায় থাকলে উপাচার্যকেও কলার ধরে বার করে দিতাম।
দেশপ্রেম জিনিসটার মধ্যে বেশ একটা জাফরানের গুণ আছে, বিরিয়ানিতে তার উগ্র মায়াজালে খারাপ হয়ে যাওয়া আলু-মাংস বেশ চালিয়ে দেওয়া যায়। স্বপ্নের ফেরিওয়ালা হয়ে ক্ষমতায় এসে দু বছরে সাড়ে উনিশটা প্রকল্পের নাম-করণ আর পৌনে বারোটা পুরনো প্রকল্পের নাম-বদল ছাড়া কিছু না হলে সেই জাফরান কাজে দেয় খুব। স্বপ্নের বদলে আতঙ্ক ফেরি করতে হলে দেশপ্রেমের তুল্য কবচকুণ্ডল আর কোথায়? পাঠানকোট কেলেঙ্কারির পর ভারতীয় সেনার আত্মত্যাগ-গাথার ধুম লেগেছে ফেসবুক-কমলে। যেন এই প্রথম সেটা জানা গেল।
এই যে প্রবল লাথি-লাঠি-বন্দুক-বাহিনীর দেশ, সেই দেশের জন্য প্রেমসুধারসের মধ্যে অন্য মানুষের মুক্তির কথা কেন, কবে, কোথায়? ও সব তো নিছক দেশদ্রোহিতার নামান্তর। এতদিন যত লোক ‘নিপাত যাক’ স্লোগান দিয়েছে, কুশপুতুল পুড়িয়েছে, দরিদ্র-শোষিত-অবহেলিত এবং দলিতদের ‘মুক্তি’র কথা বলেছে, তাদের সকলের বিরুদ্ধেই খুনের চেষ্টার মামলা ঠোকা যায়। আর হ্যাঁ, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় দল থেকে বাদ পড়ার পর চ্যাপেল-এর ভারতের প্রতিটি ক্রিকেট-ম্যাচে ভারতের হার চেয়ে যারা মানত করেছিল, সেই লক্ষ লক্ষ বাঙালি-ই বা আজ জেলের বাইরে কেন? দেশদ্রোহীর সাপ্লাইয়ে ওদেরই প্রথমে লাইনে ঢোকানো যেতে পারে।
আশ্চর্য, সরকারের টাকাতেই যে ছাত্রদের পড়ার খরচ চলে, তারাই আবার বজ্জাতীয় সব স্লোগান দেয়! আমার সরকারের টাকায় তৈরি রাস্তা দিয়ে হাঁটলেও যে আমার কথা ছাড়া অন্য কিছু মানা যায় না, তা কি বুঝিয়ে দিতে হবে? এক শিক্ষামন্ত্রী বলে দিয়েছেন, মাইনে যেখান থেকে আসে, গলানোর মতো নাকও সেখান থেকেই। আর অন্য শিক্ষামন্ত্রী, যিনি উচ্চশিক্ষার চৌকাঠও মাড়াননি, তাঁর কাছেও শিক্ষার নিদান সরল ও সোজা, ২০৭ ফুট। পতপত করে উড়ুক জাতীয়তার জয়ধ্বজ, তবে না উৎকৃষ্ট শিক্ষা। গবেষণা, স্বাধীন মতপ্রকাশ, বিতর্ক, মুক্ত চিন্তা, এ সব শিশিবোতল দিয়ে ভারতমাতার উন্নতি হবে? আসলে ‘কলা’ বিষয়টাই গোলমেলে। হনুমানের জন্যে যা সুখাদ্য, পড়াশোনার জগতে এলেই তাকে ঘিরে মতপ্রকাশের নামে বাঁদরামি শুরু হয়। তার চেয়ে বরং সবাই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুক। প্রচুর সাইবার-কুলি তৈরি হবে, দেশভক্ত নেতারা তাদের দরকারে অদরকারে পাশে পাবেন।
কলাবিদ্যাই অশান্তির মূলে, কবেই জানা কথা। ওই ফরাসি কলা-তাত্ত্বিক দার্শনিক ভলতেয়ারই বলেছিলেন না যে, ‘আমি তোমার মতের বিরুদ্ধে হলেও তোমার মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য আমি জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়ব’?
ইন্টারপোলের সাহায্য চাওয়া যেতে পারে ওঁকে ধরার জন্য!