রাষ্ট্রীয় শিক্ষানীতি ২০২০ নিয়ে খুব শোরগোল হচ্ছে। বলা হচ্ছে, এই নীতি বেসরকারিকরণের একটা বিশেষ পদক্ষেপ। এ আশঙ্কা অযৌক্তিক। সরকার তার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি চায় না। তার প্রমাণ হিসেবে এটা বলা যেতে পারে যে, শিক্ষাখাতে সরকারি বরাদ্দকে জিডিপি’র ৬ শতাংশে নিয়ে যাওয়ার পক্ষে জোরালো যুক্তির অবতারণা করেছে এই নীতি। শিক্ষার উন্নতির জন্য বেসরকারি অর্থনৈতিক সাহায্য নেওয়ায় আপত্তি করা হয়নি বটে, কিন্তু সেটা এ দেশে নতুন কোনও ব্যাপার নয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পণ্ডিত মদনমোহন মালবীয় বেসরকারি সাহায্য নিয়ে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ কখনও বেসরকারি সাহায্য নিতে পিছপা হননি। বিশ্বভারতী উন্নতিকল্পে তেমন সাহায্য নিয়ে তৈরি হয়েছিল রতন কুঠি অতিথি নিবাস, বিড়লা গার্লস হস্টেল ইত্যাদি। চীনা ভবন এবং নিপ্পন ভবনের জন্যও বিদেশি সরকারের অর্থ সাহায্য নেওয়া হয়েছিল।
বেসরকারি আর্থিক সাহায্য নেওয়া কোনও দোষের নয়, যত ক্ষণ বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষা সংস্থাগুলো নীতি নির্ধারণে স্বাধীনতা বজায় রাখে। এই প্রসঙ্গে বলা যায়, বিশ্বভারতীর পাঠ্যক্রম এবং অন্যান্য নীতি তৈরিতে অন্য কোনও প্রতিষ্ঠানকে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ দেওয়া হয়নি। বিশ্বভারতী স্বাধীন ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতি নির্ধারণ করেছিল। ১৯৫১ সালের বিশ্বভারতী অনুশাসন তার একটা জ্বলন্ত উদাহরণ। বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য। তেমনই, দারভাঙার মহারাজ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতির জন্য অর্থনৈতিক সাহায্য করতে কখনও কার্পণ্য করেননি। কিন্তু এমন কোনও নিদর্শন পাওয়া যায়নি যে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় প্রভাব বিস্তার করতে চেয়েছিলেন। ইতিহাসে এমন ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত আছে।
এটা ঠিক যে, বেসরকারি উদ্যোগে যে সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হয়েছে সেখানে পঠনপাঠন ভাল হয়, এই যুক্তিতে অনেকেই সেখানে পড়াশোনা করতে চান। সবচেয়ে মজার কথা, যাঁরা বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে বেশি সরব তাঁরা অনেকেই আমেরিকার আইভি লিগের সঙ্গে যুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলার সময় এই পন্থার জোরালো সমর্থক হয়ে ওঠেন। ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলির বেশির ভাগই, যেমন হার্ভার্ড, প্রিন্সটন, স্ট্যানফোর্ড, ইয়েল, ইত্যাদি বেসরকারি মদতে তৈরি হয়েছে এবং চলছে। বেসরকারিকরণের আশঙ্কা সম্ভবত একটা অজুহাত মাত্র। আমাদের সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান দ্রুত নিম্নগামী। তার একটা বিশেষ কারণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে সমস্যাটা পুরনো। ষাটের ও সত্তরের দশকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বুদ্ধিমান ছাত্রছাত্রীরা অনেকেই ভারতের অন্য নানা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যোগদান করেছিলেন। যাঁরা পশ্চিমবঙ্গে থেকে যান, তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ করতে প্রায় দু’বছর নষ্ট হয়েছিল। রাজনৈতিক অস্থিরতা ঐতিহাসিক ভাবেই পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা সমস্যার একটা বিশেষ কারণ।
তথাকথিত বেসরকারিকরণের বিপক্ষে এটাও বলা হচ্ছে যে, বেসরকারিকরণ মানে সরকারি দায়িত্ব শেষ। এটা ঠিক যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরতদের স্বাভাবিক বেতন বৃদ্ধির ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাগারের ওপর চাপ বেড়েছে। সরকারি অনুদান তেমন ভাবে বৃদ্ধি পায়নি। ফলে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের কাজ প্রায় বন্ধ হওয়ার জোগাড়। এবং, উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য সরকারি সাহায্য নেই বললেই চলে। সরকার তৈরি করল হেফা (হায়ার এডুকেশন ফান্ডিং এজেন্সি), যা কিনা কানাড়া ব্যাঙ্ক চালিত একটি ঋণ দেওয়ার প্রতিষ্ঠান। হেফা থেকে আর্থিক সাহায্য নিলে বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রতি বছরে তার ১০ শতাংশ নিজের আয় থেকে শোধ করতে হবে। কিন্তু অন্তত সরকারি অনুদানে পুষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজের আয় বাড়ানোর সুযোগ কম। পড়াশোনার বা হস্টেলের ফি বাড়ানোর বিরুদ্ধে হয়তো জোরালো নৈতিক যুক্তি খাড়া করা যায়। এবং ছাত্রছাত্রীদের অসুবিধার কথা বিবেচনা করে বা ছাত্র অসন্তোষের কথা ভেবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সাধারণত ফি বাড়ানোয় বিরত থাকেন।
তবে উপায়? অনেক বিশ্ববিদ্যালয় সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতার (পিপিপি) রাস্তা নিচ্ছে। যেমন, বিশ্বভারতীতে আমরা একটা সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল বানানোর কাজে হাত লাগিয়েছি। সে জন্য সরকারি অনুদান না পাওয়ায় আমরা পিপিপি পন্থায় আমাদের উদ্দেশ্য সাধনে এগোচ্ছি। এখানে বেসরকারি হাসপাতাল চিকিৎসা পরিষেবা দেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। অর্থাৎ লাগাম-ছাড়া বেসরকারিকরণ নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থের পরিপন্থী কোনও উদ্যোগই কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের শাসনকর্তারা কখনও সমর্থন করেননি এবং ভবিষ্যতেও করবেন না।
উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক সার্বভৌমত্ব কোনও ভাবেই খর্ব হবে না এই রাষ্ট্রীয় শিক্ষানীতিতে। এখানে চার ধরনের নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়েছে। এর মাধ্যমে মান নিরূপণ, আর্থিক অনুদান ও পড়াশুনার মানের বিচার করা হবে। মান নির্ণায়ক সংস্থার সুপারিশ মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সরকারি আর্থিক অনুদান পাবে। কাজের দিক থেকে এই সংস্থাগুলো একে অন্যের পরিপূরক, যদিও তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে স্বাধীন ভাবে কাজ করার অধিকার দেওয়া হয়েছে। উপরোক্ত চারটি সংস্থার সুপারিশগুলো সুবিচার করার জন্য আর একটা উচ্চতর সংস্থার উল্লেখ করা হয়েছে: হায়ার এডুকেশন কমিশন অব ইন্ডিয়া (হেসি)। এই সংস্থাটির সদস্য মূলত শিক্ষাবিদদের মধ্যে থেকেই বাছা হবে। অতএব এই রাষ্ট্রীয় শিক্ষানীতি আমলাতান্ত্রিক-সরকারি সংস্থানের জনক হয়ে উঠবে— এ আশঙ্কা অমূলক। বস্তুত, এই কারণেই আরও বলা যায় যে, এই শিক্ষানীতি সামগ্রিক ভাবে বেসরকারিকরণের পরিপন্থী। শিক্ষাবিদদের নিয়ন্ত্রণে থাকা হেসি স্বাধীন ভাবে কাজ করতে পারবে।
শিক্ষা কখনওই টাকা কামানোর উপায় হতে পারে না— এই আদর্শের ওপর ভিত্তি করেই রাষ্ট্রীয় শিক্ষানীতি তৈরি হয়েছে। স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে, ‘উচ্চশিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ প্রতিরোধ করার জন্য এবং তা বন্ধ করার জন্য একাধিক রক্ষাকবচ ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কার্যকর হবে।’ এই মূল মন্ত্র সামনে রেখে শিক্ষানীতিতে বেশ কয়েকটা বিধানের উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথমত, প্রত্যেকটা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত পড়াশোনার মান অডিট হবে। কি সরকারি কি বেসরকারি, সমস্ত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এই মর্মে ঘোষণা করতে হবে যে, তারা কোনও ভাবেই শিক্ষাকে মুনাফা অর্জনের ব্যবস্থায় পরিণত করবে না। যদি সে রকম কোনও চেষ্টার প্রমাণ পাওয়া যায়, তবে আইনানুগ ব্যবস্থা করা হবে। দ্বিতীয়ত, সমস্ত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতি বছরের খরচের হিসেব জনসমক্ষে রাখতে হবে। অর্থাৎ সোশ্যাল অডিটের মাধ্যমেও দেখা হবে কোথাও মুনাফা লুটবার অভিসন্ধি আছে কি না। তৃতীয়ত, সরকারি ও বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিচার করার পদ্ধতি এবং মাপকাঠিও এক হবে। অর্থাৎ বিশেষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য বিশেষ মানদণ্ড রাখার যুক্তি রাষ্ট্রীয় শিক্ষানীতি নস্যাৎ করে দিয়েছে। চতুর্থত, কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিজেদের খুশিমতো ছাত্রছাত্রীদের ফি ঠিক করতে পারবে না, অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে হবে। হেসি এ বিষয়ে বিশেষ নজর রাখবে। কী পড়ার জন্য কত ফি দিতে হবে, সে জন্য নিয়ম বলবৎ করার কথাও বলা আছে শিক্ষানীতিতে। মূল উদ্দেশ্য একটাই: শিক্ষা নিয়ে কোনও রকম বাণিজ্য করার উদ্দেশ্য বরদাস্ত করা হবে না। পঞ্চমত, রাষ্ট্রীয় শিক্ষানীতি বিশেষ জোর দিয়েছে কার্যকর নেতৃত্ব এবং সুশাসনের উপর, সেটা থাকলে তবেই মেধাবী এবং বুদ্ধিমান ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষান্তে শিক্ষাদান করবার মতো মহৎ কাজে মনোনিবেশ করার উৎসাহ পাবে।
রাষ্ট্রীয় শিক্ষানীতি ২০২০ আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ নয়। এটি পথপ্রদর্শক। সমালোচনা হবে এটাই স্বাভাবিক, কারণ বিভিন্ন মতের এই দেশে সর্বসম্মত রাষ্ট্রীয় শিক্ষানীতির ধারণাটিকে সোনার পাথরবাটি বললেই চলে। যখন রাজীব গাঁধীর প্রচলিত রাষ্ট্রীয় শিক্ষানীতি ১৯৮৬ সালে জনসমক্ষে আসে, তখনও সমালোচনার ঝড় উঠেছিল। বলা হয়েছিল, সেই নীতিতে ভারতীয় ভাবধারা যথেষ্ট গুরুত্ব পায়নি। তৎসত্ত্বেও, সেই নীতির অনুসারী শিক্ষাব্যবস্থা ৩৪ বছর ভারতের উচ্চশিক্ষাকে চালনা করল। নতুন রাষ্ট্রীয় শিক্ষানীতিও সমালোচকদের চক্ষুশূল হবে এটাই স্বাভাবিক, কারণ এই নীতি ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থার খোলনলচে পাল্টাবার সাহসী প্রচেষ্টা। যেটা বিশেষ ভাবে নজর কাড়ে সেটা হল এই যে, এই রাষ্ট্রীয় শিক্ষানীতি আমরা কী ভাবব না শিখিয়ে কী ভাবে ভাবব— সেই দিকে শিক্ষার্থীর মন আকর্ষণ করছে, যা কিনা একেবারেই নতুন চিন্তার খোরাক।
উপাচার্য, বিশ্বভারতী