দর্শনে নরেন্দ্র মোদীর আগ্রহ নাই। অতএব, রাষ্ট্রের নিকট নাগরিকের যাহা প্রাপ্য, রাষ্ট্র তাহাকে কেন শর্তসাপেক্ষ করিতে পারে না, নরেন্দ্র মোদী সম্ভবত তাহা জানেন না। কী ভাবে চাপ দিয়া কাজ করাইয়া লইতে হয়, তিনি তাহা বোঝেন। জানেন, কর্মসংস্থান যোজনার টাকাটি বন্ধ করিয়া দিলে লোকে বাপ-বাপ বলিয়া আধার কার্ড করাইবে। ফলে, তিনি বহু কল্যাণমূলক প্রকল্পকেই আধার-সাপেক্ষ ঘোষণা করিয়াছেন। অর্থাৎ, আধার কার্ড না থাকিলে এই সব প্রকল্পে টাকা পাওয়া যাইবে না। সেই সিদ্ধান্ত সংবিধানসিদ্ধ নহে। ২০১৫ সালে সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চ জানাইয়া দিয়াছিল, কোনও অবস্থাতেই কোনও প্রকল্পের জন্য আধার কার্ডকে আবশ্যিক করা চলিবে না। সরকারি আইনজীবী সেই মর্মে প্রতিশ্রুতিও দিয়া আসিয়াছিলেন। কিন্তু, কেন্দ্রীয় সরকার দৃশ্যত সেই প্রতিশ্রুতিরক্ষায় আগ্রহী নহে। কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা প্রকল্প হইতে পেনশন প্রকল্প, বহু ক্ষেত্রেই আধার কার্ড আবশ্যিক করা হইয়াছে। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট ফের জানাইল, আধার কার্ড না থাকিলেও কাহাকে কোনও সমাজকল্যাণমূলক খাত হইতে বাদ দেওয়া চলিবে না। এই দফায় কি কেন্দ্রীয় সরকার আদালতের রায় মান্য করিবে?
আধার কার্ড বস্তুটি সম্পর্কে প্রশ্নটি গুরুতর হইতেছে। তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষায় যে বিপুল গাফিলতির সংবাদ প্রকাশিত হইতেছে, তাহাতে সন্দেহ হয়, দেশের একশত ত্রিশ কোটি মানুষের নিরাপত্তার বিষয়টিকে সরকার যথেষ্ট গুরুত্ব দেয় তো? সেই প্রশ্নটি আপাতত মুলতবি থাকুক। ধরিয়া লওয়া যাউক, উন্নয়নের কাজে আধার অতি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু, কোনটির গুরুত্ব বেশি— প্রত্যেকটি মানুষের যাহাতে আধার কার্ড থাকে, তাহা নিশ্চিত করা, না কি কোনও মানুষ যাহাতে এক দিনের জন্যও তাঁহার প্রাথমিক অধিকারগুলি হইতে বঞ্চিত না হন, তাহা দেখা? নরেন্দ্র মোদীর উত্তর দ্ব্যর্থহীন। দরিদ্রতম মানুষের অন্নের সংস্থান অপেক্ষা তাঁহার নিকট সব মানুষের আধার কার্ড থাকিবার নৈর্ব্যক্তিক লক্ষ্যটি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু, তিনি চাহিলেও যে দেশের সংবিধান তাঁহাকে সেই অনুমতি দেয় না, দফায় দফায় সুপ্রিম কোর্টের রায় সেই কথাটি স্মরণ করাইয়া দিতেছে। খাদ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান এই দেশে মানুষের অধিকার। তাহা সরকারের বদান্যতার উপর নির্ভরশীল নহে। কোনও কারণেই যে সেই অধিকার কাড়িয়া লওয়া চলিতে পারে না, এমনকী প্রধানমন্ত্রী চাহিলেও নহে, সুপ্রিম কোর্টের রায়ে তাহা স্পষ্ট।
তবুও, প্রধান বিচারপতি জে এস খেহার-এর নেতৃত্বাধীন বেঞ্চের রায়ের একটি অংশ লইয়া প্রশ্ন থাকিয়া যায়। মহামান্য আদালত বলিয়াছে, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলার মতো কাজে সরকার চাহিলে আধার কার্ড আবশ্যিক করিতে পারে। যেহেতু ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলিতে কয়েক দিন বা কয়েক মাস বিলম্ব হইলেও তাহা কাহারও জীবনযাপনের অধিকার ব্যাহত করিবে না, ফলে এই সিদ্ধান্তটির যুক্তি খুঁজিয়া পাওয়া সম্ভব। কিন্তু, কোনও একটি ক্ষেত্রে আধারকে আবশ্যিক করিবার অনুমতি দেওয়ার অর্থ, আধার যে সম্পূর্ণ রূপে স্বেচ্ছানির্ভর এবং কোনও অর্থেই বাধ্যতামূলক নহে, সুপ্রিম কোর্টেরই এই অবস্থান হইতে বিচ্যুত হওয়া। মহামান্য আদালতের রায়ের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা বজায় রাখিয়াও প্রশ্ন: আদালত কি আর এক বার ভাবিয়া দেখিবে?