আখ্যানকার শরৎচন্দ্রের অমরতা আমাদের ওপর নির্ভরশীল নয়। কোনও অমরতাই নয়। অমরতা মাত্রেই আত্মনির্ভর। আখ্যানকারদের অমরতার একটি নিরিখ, তাঁদের তৈরি মানুষজন বা তাঁদের লেখা কথাবার্তা কতটা প্রবাদ হয়ে ওঠে। শরৎচন্দ্র এ বিষয়ে অতুলনীয়ই বলা যেত, যদি খুব সাম্প্রতিকের খবরের কাগজের পাতায় রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতার প্যারডি নানা প্রসঙ্গে ব্যবহার না হত।
‘শ্রীকান্ত’-র টগর বোষ্টমীকে মনে পড়ছে। সে তার বিশ বছরের নিচু জাতের জীবনসঙ্গী সম্পর্কে বলতে গিয়ে নিজের উচ্চবর্ণের অহঙ্কারে বলছে: একসঙ্গে থাকতে পারে, কিন্তু বিশ বছরে কোনও দিন তার সেই সঙ্গীকে হেঁশেলে ঢুকতে দেয়নি।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফরের সঙ্গী হতে রাজি হয়েছেন।
আমরা তো খবরের কাগজসর্বস্ব মানুষ। খবরের কাগজে যা বেরোয়, তাকে সত্য বলে ধরে নিয়ে মনে মনে সেই সত্যের ভিত্তি হিসেবে অপ্রকাশিত অনেক মিথ্যে কল্পনা করে দিন কাটাই। সেটাই আমাদের রাজনীতি। সেই খবরেই জানা গেল, মমতার কথা অনুযায়ীই নাকি মোদী-সফরে ‘তিস্তা জলবণ্টন’ আলোচ্যসূচির বাইরে রাখা হয়েছে। খবরে আরও জানা গেল, ছিটমহল হস্তান্তর চুক্তি সই হয়ে গেলেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ফিরে আসবেন, আধবেলা পরেই।
এ খবরগুলো সত্য হতে পারে, মিথ্যেও হতে পারে। কিন্তু আমরা, যারা রোজকার কাগজের খবরের ভিতরে একটা কারণ খুঁজে বেড়াই, তাদের মনে একটা বা কয়েকটা সরল জিজ্ঞাসা জেগে উঠছে। মমতার এত তাড়া কীসের?
নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে ঢাকায় যাওয়ার এত দায় কীসের? ছিটমহল হাতবদলের সিদ্ধান্ত ও সেই অনুযায়ী সংবিধান সংশোধনের অধিকার পার্লামেন্টের এক্তিয়ারে। পার্লামেন্ট সেই দায়িত্ব নির্বাহ করেছেন। নরেন্দ্র মোদী-হাসিনার ভিতর এই চুক্তি-সই দিল্লিতেও হতে পারত। কিন্তু মোদীর বাংলাদেশ যাওয়াটা বাকি ছিল। এই সুবাদে সেটা হয়ে যাবে।
এর মধ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কোথায়? নরেন্দ্র মোদীর মন্ত্রিসভার বিদেশমন্ত্রী তাঁকে অনুরোধ করেছেন মোদীর সঙ্গে যেতে, মমতা সম্মত হয়েছেন। কিন্তু কেন্দ্রের বিদেশমন্ত্রী কি কখনও এই ফোনটা করতেন, যদি কেন্দ্র ও রাজ্যের সেক্রেটারিদের মধ্যে ফোনাফুনিতে এটা স্থির হয়ে না যেত যে মমতা মোদীর সঙ্গে সফরে যেতে চান? মমতার ইচ্ছে না জানলে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধিদল তৈরিতে মমতার নাম আসতেই পারে না। আর, মমতাকে এই প্রতিনিধিদলের ভিতরে এনে মোদীর একশোর ওপর দু’শো শতাংশ লাভ, আর মমতা দু’শো-র উপর পাঁচশো শতাংশ ক্ষতি।
কিন্তু মমতাকে হেঁশেল সামলাতে হবে। তাই খবর রটল, তিস্তা চুক্তি নিয়ে কোনও কথা হলে নাকি তিনি যাবেন না, হেঁশেলের জাত রাখবেন।
দু’দেশের প্রধানমন্ত্রী সীমান্তের অদলবদল নিয়ে চুক্তিতে সই করবেন। এর ভিতর তিস্তার কথা ওঠে কোত্থেকে? একমাত্র এমন একটা আওয়াজ দেওয়া ছাড়া যে, হেঁশেলের জাত ঠিক আছে। এ ক্ষেত্রে তিস্তা হচ্ছে হেঁশেল।
যদ্দূর মনে পড়ছে, মাস পাঁচ-সাত আগে এই ছিটমহলই কিন্তু মমতার হেঁশেল ছিল। তিনি তখন হিসেব দিয়ে বলেছিলেন, ছিটমহল হস্তান্তরের ফলে পশ্চিমবঙ্গের হাত থেকে যত জমি বাংলাদেশের হাতে যাবে, তার চাইতে অনেক অনেক কম জমি বাংলাদেশের হাত থেকে পশ্চিমবঙ্গের হাতে আসবে।
এই হিসেবে একটা অর্ধসত্য ছিল। সংখ্যার হিসেবটা সত্যি হলেও, আসলে যে সব ছিটমহল পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশে যাবে, তার বড় একটা অংশ নদীর পরিত্যক্ত চর। তাতে মানুষ তো দূরের কথা, পাখিও থাকে না।
ছিটমহল হস্তান্তর নিয়ে মমতা তাঁর এই সরবতা থেকে কবে সরে এলেন, এটার হিসেব আমরা জানি না। কবে তিনি মনে করলেন, ছিটমহল তাঁর হেঁশেল নয়।
আর এটাও আমরা জানি না, কেন মমতা উল্টে চাইছেন না যে তিনি মোদী-সফরে প্রতিনিধি দলের অন্তর্ভুক্ত হবেন শুধু এই শর্তে যে, তিস্তা নিয়ে কথা হবে ও তিস্তা ব্যারেজ ভেঙে দিয়ে তিস্তাকে তিস্তায় ফিরিয়ে দেওয়া হবে। কেন মমতা চাইবেন না যে, বাংলাদেশে জল দেওয়ার ব্যাপারেই নয়, তিস্তা ব্যারেজ উত্তরবঙ্গেরও জল পাওয়ার বড় বাধা।
কাগজেই পড়লাম, কল্যাণ রুদ্র কমিটির কথা নাকি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন। এও নাকি বলেছেন যে, সেই কমিটির সুপারিশ নিয়ে তাঁরা চিন্তাভাবনা করছেন।
এটা একটা খবর বটে। যদ্দূর মনে পড়ছে, কল্যাণ রুদ্র তাঁর সঙ্গে দেখা করে কিছু দরকারি তথ্য চেয়েছিলেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নাকি তাঁকে বলে দিয়েছিলেন— আপনাকে এ নিয়ে আর কিছু করতে হবে না। কল্যাণ রুদ্র কোনও সুপারিশ করেছেন বলে কারওই জানা নেই। এখন মমতার হেঁশেলের জাত রাখার চৌকিদার হিসেবে কল্যাণ রুদ্রের নাম এসে গেল কোত্থেকে?
বামফ্রন্ট, বিশেষত সিপিআই(এম)-এর প্রেত-তর্পণ না করে মমতা কোনও দিন জল গ্রহণ করেন না। কিন্তু বামফ্রন্ট সরকারের যেটা প্রকাশ্য ও প্রমাণিত মারাত্মক অপকল্পনা— তিস্তা ব্যারেজ— সেটি রক্ষা করার ব্যাপারে মমতা খড়্গহস্ত। যেন বাংলাদেশ তিস্তার সব জল নিয়ে নিতে চাইছে। মমতা বলেছেন, কাগজে পড়লাম, উত্তরবঙ্গকে বঞ্চিত করে তিনি বাংলাদেশকে তিস্তার জল দিতে পারেন না।
দেশপ্রেম খুব মহৎ আবেগ। কিন্তু সেটা নির্ভর করে কে তার দেশ বলতে কী বোঝে।
আমরা অজস্র বার বলছি, তিস্তা ব্যারেজ তিস্তাকে হত্যা করছে। অজস্র বার জিজ্ঞেস করেছি, তিস্তায় ক্যানাল কেটে গত কয়েক দশকে কৃষি ফলনের হিসেব কী? অজস্র বার ম্যাপ এঁকে, ফিতে মেপে দেখিয়েছি, তিস্তা ব্যারেজের ফলে তিস্তা-অববাহিকার ৩০ কিলোমিটার মতো লম্বা ভারতীয় এলাকায় চাষের সর্বনাশ হচ্ছে।
তিস্তা ব্যারেজের পরিকল্পনা যখন নেওয়া হয়, বামফ্রন্ট সরকারকে বলেছি, কেউ কান দেননি। তৃণমূল সরকারকে বলেছি, কেউ কান দেননি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলছি, মিথ্যে কৌলীন্যের মিথ্যে অহঙ্কার ছাড়ুন। মোদীর সফরসঙ্গী না হয়ে আপনার উপায় নেই। প্রতিনিধিদলে থেকে আধবেলায় ফেরা যায় না। ও-সব দেখানেপনা ছাড়ুন। বরং এই সুযোগ নিয়ে মোদী-হাসিনার উপস্থিতিতে বাধ্য করুন ভারত-বাংলাদেশ যৌথ তিস্তা কমিশন তৈরি করতে। ইতিহাস কোনও সুযোগ দেয় না। ইতিহাসকে সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করতে হয়। হেঁশেল ভাঙুন।