চিন থেকে এল ত্রাতা?
Coronavirus

কোভিড-১৯ সঙ্কট শুরুর আগে মোদী সরকার ছিল বিপদগ্রস্ত

ফেব্রুয়ারিতে যখন ভারতের পড়শি দেশগুলোতে করোনাভাইরাস প্রাণ নিতে শুরু করেছে, তখন তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্য এলাহি অভ্যর্থনার ব্যবস্থা করতে, আর মধ্যপ্রদেশে গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত সরকার ফেলতে ব্যস্ত।

Advertisement

কপিল কমিরেড্ডি

কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ জুন ২০২০ ০০:৪৩
Share:

মনে হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর কাছে কোভিড-১৯ হয়তো শাপে বর হয়ে এল। ২৪ মার্চ মানব ইতিহাসে বৃহত্তম লকডাউন ঘোষণা করার আগে প্রধানমন্ত্রী সঙ্কটের স্বখাত সলিলে প্রায় ডুবতে বসেছিলেন। নতুন আইনে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতাকে তাঁর সরকার যে ভাবে বিকৃত করছিল, তার বিরুদ্ধে দেশের সব বড় শহরে তখন প্রতিবাদ চলছিল। ফেব্রুয়ারিতে রাজধানীতে ঘটেছিল রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা, চার ডজন প্রাণ চলে গিয়েছিল। ১৯৮৪ সালের পরে দিল্লিতে এমন রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা আর হয়নি। তার আগে চলছিল নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে দেশ জুড়ে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ। কর্মহীনতা বেড়ে চলছিল সমানে, এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে মন্থর গতিতে বাড়ছিল অর্থনীতি। মনে হচ্ছিল যেন মোদীর নয়া ভারত ধরাশায়ী হওয়ার মুখে। এই সময়ে চিন থেকে ত্রাতা হয়ে এল এক ভাইরাস।

Advertisement

নরেন্দ্র মোদী গোড়ার দিকে অতটা পাত্তা দেননি বিষয়টাকে। ফেব্রুয়ারিতে যখন ভারতের পড়শি দেশগুলোতে করোনাভাইরাস প্রাণ নিতে শুরু করেছে, তখন তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্য এলাহি অভ্যর্থনার ব্যবস্থা করতে, আর মধ্যপ্রদেশে গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত সরকার ফেলতে ব্যস্ত। ইউরোপে যখন মৃতের সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে, তখনও ভারতকে প্রস্তুত করার জন্য তেমন কিছু পদক্ষেপ করা হয়নি। মার্চের শেষেও ভারতে প্রতি ৮৪,০০০ ব্যক্তি পিছু একটি কোয়রান্টিন শয্যা, প্রতি ১,১৬,০০০ রোগী পিছু এক জন ডাক্তার, এবং প্রতি ১,৮২৬ জন পিছু একটি হাসপাতাল শয্যা। টেলিভিশনে সম্পূর্ণ লকডাউন ঘোষণার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য সুরক্ষা-সরঞ্জামের প্রথম অর্ডার দেওয়া হল।

মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে কয়েক লক্ষ নারী-পুরুষ, যাঁরা উন্নত ভারতের প্রয়োজন মেটাতে শ্রম দেন— পরিচারক, পাচক, সাফাইকর্মী, নির্মাণ শ্রমিক— শহর থেকে গ্রামের দিকে ঘরে ফেরার যাত্রা শুরু করলেন। কেন্দ্রীয় সরকার তাঁদের পাশে থাকেনি। পায়ে হেঁটে তাঁদের দীর্ঘ যাত্রা ১৯৪৭ সালের দেশভাগের ভয়ানক স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। এপ্রিলের মাঝামাঝি এসে দেখা গেল, লকডাউনের ফলে প্রায় দুশো মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। কেউ পথের পরিশ্রমে মাঝপথেই মারা গেছেন, কেউ নিঃসঙ্গতা এড়াতে আত্মহত্যা করেছেন। লকডাউন কেবল রোগকে নয়, গণতন্ত্রকেও থমকে দিল বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশে। কিন্তু বর্তমান ভারতে প্রধানমন্ত্রীর কাজের সমালোচনা মানেই জাতীয় এমার্জেন্সির সময়ে ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতা’র অভিযোগ ডেকে আনা। তাঁর প্রতি আনুগত্য, তাঁর মহিমাকীর্তনই হল কর্তব্যনিষ্ঠ নাগরিকের একমাত্র লক্ষণ।

Advertisement

লকডাউনের কয়েক দিন না কাটতেই প্রধানমন্ত্রী মোদী একটি ট্রাস্ট তৈরি করলেন, যার কাজকর্ম সম্পূর্ণ অস্বচ্ছ। দরিদ্রতম মানুষদের জন্য সেখানে করমুক্ত দানের জন্য তিনি প্রচার করতে লাগলেন। নাম দিলেন ‘পিএম কেয়ার্স’। প্রথম সপ্তাহেই প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা এল সেই অ্যাকাউন্টে। সরকারি দফতরের কর্মীদের বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ‘উৎসাহ’ দেওয়া হল বেতনের একটি অংশ সেখানে দানের জন্য। বেসরকারি কর্পোরেটের কর্তারা নিজেদের নিচুতলার কর্মীদের মাইনে না দিয়ে সেই ট্রাস্টে কয়েকশো কোটি টাকা দিলেন।

টাকাগুলো গেল কোথায়? উত্তর মেলা অসম্ভব। ‘পিএম কেয়ার্স’ একটি ব্যক্তিগত ট্রাস্ট, সরকারি অডিটর যার হিসেব নিরীক্ষণ করতে পারবে না। এই অনৈতিক কাজটা এমন খোলাখুলি ঘটল যে তাক লেগে যায়। অন্য রাষ্ট্রপ্রধানরা যখন মানুষের কাছে কখনও মিনতি করছেন, কখনও ভয় দেখাচ্ছেন, ইতস্তত করছেন, তখন ভারত সরকারের তরফে এমন একটা অত্যন্ত আপত্তিকর ও দুঃসাহসিক পদক্ষেপ করা হচ্ছে। প্রসঙ্গত বলা দরকার, নরেন্দ্র মোদীর আত্মম্ভরিতা যথেষ্ট খ্যাত হলেও, ব্যক্তি হিসেবে তাঁর অর্থলিপ্সার কথা কেউ বলে না। কিন্তু গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে যাঁরা চিন্তিত, তাঁরা নিশ্চয়ই এই ভেবে স্বস্তি পেতে পারেন না যে, পিএম কেয়ার্স-এর টাকা সুইস ব্যাঙ্কে জমা পড়েনি। তাঁরা বরং বিপন্ন বোধ করবেন এই ভেবে যে, নাগরিকের দৃষ্টির অন্তরালে এই টাকা হয়তো ব্যয় হবে আরও বিপজ্জনক কোনও কাজে, উৎকোচ দিতে, কিংবা জনপ্রতিনিধিদের কিনে নিতে।

প্রধানমন্ত্রীর দফতর জানিয়েছে, ৩,১০০ কোটি টাকা এখনও অবধি পিএম কেয়ার্স থেকে বিভিন্ন চাহিদা মেটাতে খরচ হয়েছে। কিন্তু, কত জমা পড়েছিল তা স্পষ্ট করেননি তাঁরা। ওই তহবিলের টাকার উপর সরকারি নজরদারির অভাব পূরণ করতে হবে প্রধানমন্ত্রীর মুখের কথা দিয়ে, যার নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে ইতিমধ্যেই অনেক প্রশ্ন উঠেছে।

আর দরিদ্রতমদের কী হবে? বেঙ্গালুরুতে গত মাসে আপৎকালীন রেলযাত্রা স্থগিত করে দেওয়া হয়েছিল, যাতে মজুররা ঘরে ফিরতে না পারেন। দরিদ্রতমদের মৌলিক অধিকার এ ভাবে খর্ব করার ব্যাখ্যা দিয়ে মোদীর দলের সাংসদ তেজস্বী সূর্য বলেছিলেন, এ একটা বিরাট সাহসী পদক্ষেপ— যাতে বেঙ্গালুরুতে আগত মজুরদের উন্নততর জীবনের স্বপ্ন ফের শুরু করা যায়। কেউ সন্দেহ করতেই পারেন, বড় বড় নির্মাণ সংস্থাগুলোর স্বার্থেই শ্রমিকদের যেতে না দেওয়ার সিদ্ধান্তটা করা হয়েছিল। যে পরিযায়ী শ্রমিকদের সহায়তা করতে এত উদ্গ্রীবতা, তাঁদের ট্রেনের টিকিটের টাকাও কেন্দ্রীয় সরকার দিতে পারল না। কী অদ্ভুত পরিহাস— শ্রমিকদের থেকে যারা পুরো ভাড়া আদায় করেছে, সেই ভারতীয় রেল কিন্তু তার মাত্র কয়েক দিন আগেই ১৫১ কোটি টাকা দিয়েছিল পিএম কেয়ার্স-এ।

একই সময়ে মধ্যপ্রদেশ ও উত্তরপ্রদেশের বিজেপি সরকার অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য শ্রমিকদের একেবারে প্রাথমিক আইনি সুরক্ষাগুলিকে বাতিল করছিল। যে ভোপাল ইতিহাসে সব চাইতে বড় শিল্প-দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিল, সেই শহরের কারখানায় সুরক্ষা পরীক্ষা আর আবশ্যক নয়। যদি ভাবেন, আবার অতীত খুঁচিয়ে ভয় দেখানো কেন, তা হলে মনে করাতে হয়, গত মাসের গোড়ার দিকে অন্ধ্রপ্রদেশে বিশাখাপত্তনমের একটি পলিমার কারখানা থেকে নির্গত গ্যাসে অন্তত এগারো জন প্রাণ হারিয়েছেন।

কেউ এখন মনে করতেই পারেন— যে সামাজিক অন্যায়গুলো ভারতে চিরকালই রয়ে গিয়েছে, কোভিড-১৯’কে অজুহাত করে সেগুলোকে বৈধতা দেওয়া হচ্ছে। কেবল যে গেরুয়াধারী হিন্দু জাতীয়তাবাদীরাই শ্রমিক অধিকার সুরক্ষার আইনগুলোকে নস্যাৎ করছে, তা নয়— উচ্চমার্গের বহু টেকনোক্র্যাট অর্থনীতিবিদও তাকে মান্যতা দিচ্ছেন। প্রাচীন ভারতের ব্রাহ্মণরা যেমন অবোধ্য সংস্কৃত ভাষায় মন্ত্র পড়াতেন, যাতে নিম্নবর্ণদের কাছ থেকে দেবার্চনার পদ্ধতির জ্ঞান আড়াল করা যায়, এঁদের কথাও তেমনই দুর্বোধ্য। তাঁদের ভাষা ভরে থাকে বিচিত্র পরিভাষা আর সুখশ্রাব্য নানা শব্দে। শেষ অবধি যা দাঁড়ায়, তা হল গরিবের অধিকার হননকে অর্থনৈতিক প্রজ্ঞা বলে দেখানো। এই প্রযুক্তিবাদী প্রশাসকরা চাইছেন ভারতে এক এমন ব্যবস্থা আনতে, যাকে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অতুল কোহালি বলছেন ‘দ্বিস্তরীয় গণতন্ত্র’। সেখানে সাধারণ মানুষের প্রয়োজন হবে কেবল নির্বাচনের সময়ে। নির্বাচন চুকে গেলেই তাঁরা রাজনীতি ভুলে বাড়ি ফিরে যাবেন, আর নিঃশব্দে বাণিজ্যবান্ধব প্রশাসন চালাবে উচ্চবর্গ।

প্রধানমন্ত্রী দারিদ্রে বড় হয়েছেন, কিন্তু দরিদ্রের প্রতি তাঁর অবহেলারই পরিচয় মিলেছে এ পর্যন্ত। মনে পড়তে পারে, গত বাজেটে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছিল কেবল তাঁর জন্য এক জোড়া বোয়িং বিমান কেনার লক্ষ্যে। কেবলমাত্র প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল করার জন্য আজকের ভারতে যত হাজার কোটি টাকা নির্দিষ্ট করে রাখা হয়েছে, দেশের মানুষের দুর্দশায় তার কিছুটাও খরচ করলে পরিস্থিতি অন্য রকম হত। দেশের রাজনীতি অর্থনীতি ও সমাজে যে ক্ষত এই ছয় বছরে তৈরি হয়েছে, তা নিরাময় করতে কত দিন লাগবে, আদৌ করা যাবে কি না, বলা কঠিন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement