কাঁথা ভুলে বাঙালি এখন ‘ন্যাপিতেই হ্যাপি’

কেবল শিশুদের ক্ষেত্রেই নয়, বাড়িতে বাড়িতেও কাঁথা ব্যবহারের চল আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কাঁথা এখন বড্ড সেকেলে ব্যাপার। লিখছেন মৌসুমী মজুমদারনানা ধরনের ফুলতোলা কল্কা আঁকা রংবাহারি নকশিকাঁথা গ্রাম বাংলার, বিশেষ করে মুসলিম জনসমাজের এক ঐতিহ্যবাহী লোকশিল্প।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০১:২৩
Share:

কাঁথা।

খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে আমাদের চেনা পৃথিবীটা। বদলে যাচ্ছে মানুষ, বদলে যাচ্ছে রুচি, চাহিদা, সংস্কৃতি। কিছু দিন আগেও নবজাতকের মুখ দেখতে এসে পাড়া-পড়শি, আত্মীয়-স্বজনেরা হাতে করে বাচ্চার জন্য দু’-চারটি কাঁথা নিয়ে আসতেন। পুরনো সুতির শাড়ি ব্যবহারের অযোগ্য হলে, সেই নরম কাপড় দিয়ে তৈরি করা হত কাঁথা। নরম কাঁথায় শুয়ে শিশু পায় মায়ের কোলের উষ্ণতা। কিন্তু বর্তমানে কাঁথাকে দূরে ছুড়ে ফেলে শৈশবের বাজার দখল করেছে বিদেশি কায়দায় তৈরি হরেক রকমের ন্যাপি। দরিদ্র জনতার কথা বাদ দিলে মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত— যাঁদেরই আর্থিক সামর্থ্য আছে, কেউ আর কাঁথা ব্যবহারের ধারে কাছ দিয়েও যেতে চান না। ন্যাপি ব্যবহারের ফলে মায়েদের বহু সুবিধে হয়েছে। বারবার কাঁথা পাল্টানো, কাচা, শুকোনোর ঝক্কি আর তাঁদের পোহাতে হয় না। ন্যাপির দৌলতে মা আর বাচ্চার রাত কাটে আরামে ও নিশ্চিন্তে। এ যুগের মায়েরা এখন ‘ন্যাপিতেই হ্যাপি’! কেবল শিশুদের ক্ষেত্রেই নয়, বাড়িতে বাড়িতে এখন কাঁথা ব্যবহারের চলটাও আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কাঁথা যেন বড্ড সেকেলে ব্যাপার। বাহারি পশমের কম্বল, হালকা লেপ কাঁথাকে কোণঠাসা করে দিয়েছে। অথচ কাঁথা আমাদের বঙ্গসংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। বাংলা প্রবাদেও শোনা যায়— শীতের কাঁথা আর বর্ষার ছাতা।

Advertisement

নানা ধরনের ফুলতোলা কল্কা আঁকা রংবাহারি নকশিকাঁথা গ্রাম বাংলার, বিশেষ করে মুসলিম জনসমাজের এক ঐতিহ্যবাহী লোকশিল্প। মূলত নকশা আঁকা কাঁথাগুলিকে নকশিকাঁথা বলা হলেও সেলাইয়ের প্রকারভেদে কাঁথাগুলি বিভিন্ন নামে পরিচিত, যেমন— সুজনি কাঁথা, কদমফুল কাঁথা, বিলাইপাউটি কাঁথা, মুরাফাঁস কাঁথা, আঙুর খোপা কাঁথা, গোলকধাঁধা কাঁথা, ঝাড়ফুল কাঁথা, ব্লেড বর্ডার কাঁথা, রুটি কাঁথা, পাঙ্খা কাঁথা। একটি কাঁথায় আবার নানা ধরনের সেলাইয়ের মিশ্রণ থাকে— ভাল স্টিচ, চিকোন, চেন বা জিজির স্টিচ, টালিফাঁস মাছকাঁটা, যবশীষ, খেজুরপাতা, হেম, রান, ভরাট ইত্যাদি।

কাঁথা পাতাও এক শিক্ষণীয় বিষয়। কাঁথার নকশার ক্ষেত্রেও সর্বত্র সামঞ্জস্য বজায় রাখতে হয়। আলপনা দেওয়ার মধ্যে যেমন এক জাতীয় জ্যামিতিক চিত্রের প্রয়োগ কৌশল থাকে, তেমনি কাঁথার নকশার ক্ষেত্রেও ফুলের সংখ্যা আকৃতি ইত্যাদির মধ্যে সমতা বজায় রাখতে হয়। নইলে আকর্ষণীয় লাগে না।

Advertisement

সংস্কৃত শব্দ ‘কন্থা’ থেকে উদ্ভুত কাঁথা শব্দের অর্থ জীর্ণবস্ত্র রচিত আস্তরণ বা শীতবস্ত্র বিশেষ। দরিদ্র লোকজন ফেলে দেওয়া জিনিসকেও কাজে লাগান। বহু ব্যবহৃত জীর্ণ-বস্ত্রটুকু নষ্ট না করে তৈরি করে ফেলেন নজরকাড়া রকমারি কাঁথা। সৃষ্টি হয় এক অসাধারণ লোকশিল্পের। একটি প্রমাণ মাপের কাঁথা তৈরি করতে প্রায় পাঁচটি শাড়ি লাগে। ছেঁড়া শাড়িগুলি ভিতরের দিকে দিয়ে, অপেক্ষাকৃত ভাল শাড়ি দিয়ে ঢাকা দেওয়া হয়। এমনকি কাঁথা সেলাইয়ের জন্য প্রয়োজনীয় সুতোটুকুও সংগ্রহ করা হয় শাড়ির পাড় থেকেই। তবে পরবর্তী কালে কাঁথা সেলাইয়ে উল চিরে নিয়ে সেলাই করা হয়, এতে সুতোর ঔজ্জ্বল্য বজায় থাকে।

মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে জন্ম-মৃত্যু, বিয়েতে কাঁথার ব্যবহার দেখা যায়। বিছানার উপর নানা রকমের কাঁথা বিছিয়ে অতিথিদের অভ্যর্থনা জানানো হয়। বিয়েতে কাঁথা যৌতুক দেওয়া হয়। এমনকি মৃত্যুর সময় শবদেহ কাঁথা দিয়ে আচ্ছাদিত করা হয়। মুসলিম মহিলারা অনেকেই বংশ পরম্পরায় কাঁথা তৈরির সঙ্গে যুক্ত থাকেন। মা থেকে মেয়ের হাত ধরেই সূচিশিল্প প্রসার লাভ করে। বহু হিন্দু মহিলাও কাঁথা সেলাই করে জীবিকা অর্জন করেন। আবার অনেকে অবসর কাটানোর উপায় হিসাবেও কাঁথা সেলাই করেন। যদিও বর্তমানে বাড়িতে বসে কাঁথা সেলাই করা এখন এক বিরল দৃশ্য। সুক্ষ সূচিশিল্প বা বহু সময় ব্যয়ে সৃষ্ট নানা হস্তশিল্প যেগুলি বাড়ির মা, মাসিমা, ঠাকুমা, দিদিমারা সকলের সঙ্গে গল্প করতে করতে তৈরি করতেন, সেগুলি আজ অবলুপ্তির পথে। ক্রচেটের সুতো দিয়ে তৈরি বিছানার চাদর, আয়নার ঢাকনা, টেবিলক্লথ থেকে শুরু করে নকশাদার কাঁথা সবই এখন বাজারি পণ্যের কাছে পরাজিত।

কাঁথা শিল্প বহু দরিদ্র পরিবারের অর্থ উপার্জনের একটি মাধ্যম। কাঁথা শিল্পকে যাঁরা পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন, তাঁরা নাগাড়ে সকাল, দুপুর, বিকেলে নিয়ম করে কাঁথা তৈরি করেন এবং মোটামুটি মাস খানেকের মধ্যে একটি কারুকার্য করা কাঁথা তৈরির কাজ শেষ করেন। তবে যাঁরা বাড়িতে ব্যবহারের জন্য বা শিল্পসৃষ্টির জন্য কাঁথা তৈরি করেন, তাঁদের গৃহকর্ম ইত্যাদি সারার পরে এমন কল্কাতোলা কাঁথা শেষ করতে বছর ঘুরে যায়। সাংসারিক কাজের পরে শীতের দুপুরে, পিঠে রোদ মেখে বাড়ির ছাদে বা বারান্দায় চলে কাঁথা তৈরির কাজ। একা একা কাঁথা সেলাই করার চেয়ে মহিলা মজলিসে হাসি-ঠাট্টা গল্পের সঙ্গে কাঁথা সেলাই কাজের একঘেয়েমি দূর করে।

কিন্তু বর্তমানে কাঁথা শিল্প মৃতপ্রায়। শহুরে জীবনে কাঁথার কদর আর আগের মতো নেই। একটি কল্কাদার নকশি কাঁথা তৈরি করতে এক জন কাঁথাশিল্পীর যে পরিমাণ পরিশ্রম হয়, সেই পরিমাণ মজুরি তাঁরা পান না। একটি ঝাড়ফুল বা আঙুরখোপা কাঁথার মূল্য এক হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা। জীর্ণ শাড়ি দিয়ে তৈরি কাঁথার জন্য এত খরচ করতে অনেকেই বিমুখ। এ ছাড়া সস্তা কম্বলে বাজার এতটাই ছেয়ে গিয়েছে যে প্রতিযোগিতায় কাঁথার টিকে থাকা মুশকিল।

আসলে বিদেশি ভোগ্যপণ্যের রমরমা আর চাকচিক্য আমাদের নিজস্ব রুচি ও সংস্কৃতির পরিবর্তন ঘটিয়ে দিচ্ছে। মুক্তবাজারের অর্থনীতিতে সব রকমের পণ্যদ্রব্য আজ আমাদের হাতের মুঠোয়। বিজ্ঞাপনের কারসাজিতে জনতার দৃষ্টি আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে। আমাদের ঐতিহ্যবাহী লোকশিল্প-হস্তশিল্পগুলি আজ বড়সড় বিপর্যয়ের মুখোমুখি। আত্মঘাতী বাঙালি ভুলে যাচ্ছে তার সংস্কৃতি, অতীত। স্বদেশের ঠাকুর ফেলে বিদেশের কুকুর ধরতে আমাদের জুড়ি নেই।

কাঁথা আমাদের ঐতিহ্যের অংশ। নকশি কাঁথা বাংলার গ্রাম্য জনতার জীবনের দর্পণ, শিল্পীর অন্তরঙ্গ অনুভূতির প্রকাশ। বহু মানুষের চিন্তা-ভাবনা, শিল্পবোধ জড়িয়ে আছে কাঁথার সঙ্গে। কাঁথাকে জীবন থেকে বাদ দিলে, বাদ পড়ে যাবে আমাদের লোক-ঐতিহ্য, বাদ পড়ে যাবে আমাদের পূর্বপুরুষ দ্বারা রক্ষিত ও বাহিত এক সংস্কৃতি। কাঁথার অপরূপ ফোঁড়ের মতোই জীবনে গেঁথে নিতে হবে আমাদের পরম্পরায় লালিত ঐতিহ্যকে।

শিক্ষিকা, মণীন্দ্রনগর উচ্চ

বালিকা বিদ্যালয়

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement