সত্তর দশকের মাঝামাঝি তৈরি মৃণালবাবুর কোরাস ছবিটা পঁয়তাল্লিশ বছর পেরিয়েও কেমন প্রাসঙ্গিক!
জনমজুর খাটতাম... তো কাজকম্মো নেই... জনমজুর জনমজুর’ বলে নিজেকে চেনাতে থাকেন মানুষটি। যাঁদের বলছিলেন, তাঁরাও শ্রমিকের দল, হেঁটে আসছিলেন বহু দূর থেকে, তাঁদের মধ্যেই কেউ একজন বলে ওঠেন: ‘পাগল’। শুনে এই মানুষটিও সায় দেন: ‘লোকে তাই বলে বটে... দেশের যা অবস্থা, তাতে ঠিক থাকে মাথা?’ তাঁকে নিয়েই এগোতে থাকে শ্রমিকের দল, একজন গেয়ে ওঠেন আর বাকি সকলে তাতে গলা মেলান: ‘হম ভুখসে মরনেওয়ালে, কেয়া মওতসে ডরনেওয়ালে...’।
দীর্ঘ পথ পেরিয়ে আসছিল শ্রমিকের দলটি। অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন ছ’মাস যাবৎ, তাঁদের ন্যূনতম মজুরি দেওয়ার রায় বেরিয়েছে, তবু মালিকপক্ষ মানেনি, শ্রমিকদের বাধ্য করেছে ধর্মঘটে যেতে। পথ-হাঁটা সেই শ্রমিকের দলটিকে রাস্তায় আটকান বকুলপুর গ্রাম থেকে আসা জনকয়েক কৃষক, ‘কিছু মুড়ি আর খেতের শসা এনেছি... আর কিছু করা গেল না, আমরা বড় গরিব... দয়া করে যদি এই যৎসামান্য...’। শুনে দলের এক জনের চোখ ভরে আসে জলে, অন্য জন গিয়ে জড়িয়ে ধরেন তাঁদের। তার পর আবার হাঁটতে শুরু করেন তাঁরা, গলায় সেই একই গান: ‘হম ভুখসে মরনেওয়ালে, কেয়া মওতসে ডরনেওয়ালে...’
মৃণাল সেনের কোরাস ছবির এই দৃশ্য মনে পড়ে গেল সৈফুদ্দিনের কথায়: ‘খাবার কেনার পয়সাও নেই। রাস্তায় কেউ খেতে দিলে খাচ্ছি, না-হলে খালিপেটেই হাঁটছি।’ কাজ বন্ধ, তাই মাইনেও পাননি। ফোস্কা-পড়া পা আর পিঠের অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে নাগাড়ে হেঁটে উত্তরপ্রদেশের মোরাদাবাদ থেকে দশ দিনে পটনায় পৌঁছেছেন এই পরিযায়ী শ্রমিকেরা, খবর বেরিয়েছে কাগজে। আর-একটি প্রতিবেদনে ছিল: শিল্পমহলের একাংশের চাপেই শ্রমিকদের আটকাতে চেয়েছিল কেন্দ্র। যাতে লকডাউনের পরে ঝাঁপ উঠলে নির্মাণ শিল্প, কলকারখানায় কর্মীদের টান না পড়ে। কিন্তু এক মাসেরও বেশি ঠিকমতো খাবার, জল, ওষুধ, মাথা গোঁজার জায়গা না পেয়ে ফুঁসছিলেন কর্মীরা। যার প্রতিফলন ঘটছিল সুরাত, হায়দরাবাদের বিক্ষোভে।
সত্তর দশকের মাঝামাঝি তৈরি মৃণালবাবুর ছবিটা পঁয়তাল্লিশ বছর পেরিয়েও কেমন প্রাসঙ্গিক! আসলে এই অমানবিকতা তো বরাবরের, সাম্প্রতিক এই অতিমারির সঙ্কটের আড়ালে নীরবে ফুলেফেঁপে উঠেছে বহু কাল ধরে। দাসত্ব যেন নিত্যসঙ্গী খেটে-খাওয়া শ্রমিকদের— তাঁদের খেতেও দেওয়া হচ্ছে না, জোর করে আটকেও রাখা হচ্ছে।
আশির দশকের গোড়ায় মৃণাল সেনের আকালের সন্ধানে মনে পড়ে? সে ছবিতে দুর্গাকে? দু’মাসের অসুস্থ বাচ্চাকে ফেলে তার গ্রামে মন্বন্তরের ছবি তুলতে আসা ফিল্ম-ইউনিটে কাজ করতে যেত সে রোজ, প্রতি দিন সাত টাকা করে পেত, সঙ্গে এক বেলার খাবার। ছবির নায়িকা মানবিকতাবশতই তাকে ছেলের কাছে ফেরত পাঠিয়ে দেন এই আশ্বাসে যে তার দৈনিক মজুরি কাটা যাবে না। তাতে অবশ্য তার ভয়ঙ্কর অভাব ঘোচে না। সেই দুর্গা এক রাতে দুর্ভিক্ষের শুটিং দেখে এসে হাঁড়িতে দু’মুঠো চাল চাপিয়ে স্বামীকে প্রশ্ন করেছিল, ‘আচ্ছা তুমি আকাল দেখেছ?’ তার পর অবশ্য নিজেই বলে, ‘তুমি কী করে জানবে, সে তো অনেক কাল আগের কথা...’, সংলাপ প্রায় শেষ হতে-না-দিয়েই পরের দিন সকালের বাজারে আমাদের টেনে আনেন মৃণাল সেন— অফুরান খাদ্যসামগ্রী, থরে থরে সাজানো আনাজ মাছ ডিম...
আমাদের বেঁচে থাকার অসঙ্গতিকে বার বার তিনি এমন ভাবে ফিরিয়ে আনেন যে তাঁর ছবি বড় অস্বস্তিতে ফেলে দেয় আমাদের। দেশে খাদ্যের প্রাচুর্য সত্ত্বেও বহু মানুষ ক্ষুধার্ত থাকতে বাধ্য হয়, কেন? বাজারে খাবারের জোগান আছে, এক দলের দখল আছে সেই খাবারের উপর, অথচ অধিকাংশেরই তা নেই বলে অর্ধাহার-অনাহার তাদের নিত্যসঙ্গী। বাইশে শ্রাবণ, ইন্টারভিউ, কলকাতা ৭১, পদাতিক, মৃগয়া, ওকা উরি কথা, পরশুরাম, একদিন প্রতিদিন, খারিজ, জেনেসিস, মহাপৃথিবী... তাঁর একের পর এক ছবিতে রুগ্ন নিরন্ন শীর্ণ বিপন্ন মানুষের চেহারা প্রায় যতিচিহ্নের মতো আসতে থাকে, আসতেই থাকে। তাঁর ছবির বাস্তব এতই রুক্ষ, স্ববিরোধী আর অসুন্দর যে তা দুঃস্বপ্নের মতো এখনও তাড়া করে ফেরে দর্শককে।
স্বাধীনতার পর থেকে টানা এই নতুন শতক অবধি ছবি করে গিয়েছেন মৃণাল সেন, কিন্তু জন্ম তো তাঁর পরাধীন ভারতবর্ষেই। জন্মের সময় মাথার উপর ছিল প্রায় দেড়শো বছরের ঔপনিবেশিকতার চাপ, সেই চাপ প্রতিনিয়ত রক্তের মধ্যে টের পেতেন তিনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দাঙ্গা, দুর্ভিক্ষ, দেশভাগ কী ভাবে দিনের পর দিন মানুষকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলেছে, আর তার জের স্বাধীনতার এত বছর পরেও কী ভাবে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে, আমাদের জীবনের সেই অসম্পূর্ণতার উত্তরই যেন নিজের ফিল্মের নিয়মে খুঁজে গিয়েছেন মৃণাল সেন।
পরশু ছিল তাঁর সাতানব্বই পূর্ণ-হওয়া জন্মদিন। এই দুঃসময়ে অতিমারির আবহে অর্থনীতির হাওয়া ঘোরাতে শ্রম আইন শিথিল করার চেষ্টা চলছে। বিভিন্ন রাজ্যে ৮ থেকে বাড়িয়ে ১২ ঘণ্টা কাজ করতে বলা হচ্ছে শ্রমিকদের, আরও বেশি শ্রমিক-শোষণের দিকে ফিরে যাচ্ছি আমরা। শাসকের আচরণ কতখানি নির্মম হতে পারে তার নজির আবার সেই মৃণালবাবুর কোরাস-এ, কিন্তু সে-ছবিতে এমন মুহূর্তও আসে যখন শাসকদের পুরোধা বলে ওঠেন: ‘আচ্ছা আপনাদের কখনও গা ছমছম করে না? কেন জানি না আমার মাঝেমাঝেই মনে হয়, পুরো দেশটা একটা ভলক্যানোর ওপর দাঁড়িয়ে আছে, যে কোনও সময় এক্সপ্লোড করতে পারে!’