Science

আরও জ্ঞানের প্রয়াস

জ্ঞানের কোনও পরিসীমা নাই জানিয়াও গবেষণায় ক্ষান্তি না দেওয়া। কণারাজ্য অনুসন্ধানের যে তত্ত্ব স্ট্যান্ডার্ড মডেল নামে খ্যাত, সেই জিগস পাজ়ল-এর শেষ খণ্ড হিগস বোসন ওরফে ঈশ্বরকণা সম্পর্কে গত এক দশকে কম কথা শোনা যায় নাই।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৯ জুলাই ২০২০ ০১:০০
Share:

সত্যজিৎ রায়-কৃত ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্রের সংলাপ বহু মানুষের মুখে মুখে ঘুরিয়া বেড়ায়: ‘জানার কোনও শেষ নাই, জানার চেষ্টা বৃথা তাই’। বাক্যটি বক্রোক্তি, অবশ্যই। জানিবার কৌতূহল মানুষের স্বভাবজাত। বাস্তবিক, অতিরিক্ত জানিবার উদগ্র বাসনাই মনুষ্যকে জীবকুলে স্বাতন্ত্র্য দিয়াছে। ওই প্রবৃত্তিবলের বিবর্তনে মনুষ্য নিজের ভাগ্য রচনা করিয়াছে। প্রকৃতির শতেক বাধাবিপত্তি অতিক্রম করিয়া আপন উন্নতি বিধানের ক্ষমতা মানুষেরই আছে, অন্য জীবের নাই— তাহা ওই বাড়তি জ্ঞানের কারণে। দিবারাত্রির মূলে যে পৃথিবীর আহ্নিক গতি, অথবা পৃথিবী যে গোলকাকৃতি, ইত্যাকার উপলব্ধি পিপীলিকাগণের নাই, মনুষ্যের আছে। তাই মনুষ্যগণ দিবারাত্রির ব্যবধান ঘুচাইবার নিমিত্ত আলো জ্বালাইবার ক্ষমতা অর্জন করিয়াছে, পিপীলিকারা তদ্রূপ ক্ষমতা অর্জনে ব্যর্থ। এমতাবস্থায় বেশি জ্ঞানার্জন কোনও মতেই দোষ গণ্য হইতে পারে না। অধিক জ্ঞান সঞ্চয় দোষ গণ্য করিতে পারে কেবল মূর্খেরাই। কেবল মূর্খরাই নূতন জ্ঞানার্জনকে তাচ্ছিল্য করিবার হঠকারিতা প্রদর্শন করিতে পারে, পণ্ডিতদের কাজকর্মের মূল্যকে অস্বীকার বা অবমাননা করিতে পারে।

Advertisement

বিজ্ঞানীদের কাজও ইহাই। সতত অধিকতর জ্ঞানার্জনের চেষ্টা করা। জ্ঞানের কোনও পরিসীমা নাই জানিয়াও গবেষণায় ক্ষান্তি না দেওয়া। কণারাজ্য অনুসন্ধানের যে তত্ত্ব স্ট্যান্ডার্ড মডেল নামে খ্যাত, সেই জিগস পাজ়ল-এর শেষ খণ্ড হিগস বোসন ওরফে ঈশ্বরকণা সম্পর্কে গত এক দশকে কম কথা শোনা যায় নাই। প্রায় পঞ্চাশ বৎসরব্যাপী অনুসন্ধানের পর ২০১২ সালে কণাটির সন্ধান মিলিয়াছিল। কণাটি পদার্থের ভর সরবরাহ করিয়া থাকে। ভর যে হেতু এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের এক অতীব গুরুত্বপূর্ণ ধর্ম— ভর ব্যতীত পদার্থকণা ছোটাছুটি করিয়া বেড়াইত, কখনওই জমাট বাঁধিয়া গ্রহ-উপগ্রহ, নদী-নালা, পাহাড়-পর্বত, গাছপালা, এমনকি মানুষ তৈরি হইতে পারিত না— তাই ভরের উৎস সন্ধান বিজ্ঞানে এক গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সুইৎজ়ারল্যান্ডের জেনিভা শহরের সন্নিকটে সার্ন গবেষণাগারে লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার যন্ত্রে অনেক সাধ্যসাধনার পর হিগস বোসন আবিষ্কৃত হয়। ওই আবিষ্কার এতই গুরুত্বপূর্ণ যে আবিষ্কারের এক বৎসরের মধ্যে হিগস বোসনের দুই কল্পনাকার বিজ্ঞানী স্যর পিটার হিগস এবং ফ্রাঁসোয়া এংলার্ট পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার পান। ১৯৯৮ হইতে ২০০৮ সাল পর্যন্ত দশ বৎসরের চেষ্টায় লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার যন্ত্রটি নির্মিত হইয়াছিল। ভূগর্ভে ১৭৫ মিটার গভীরে ২৭ কিলোমিটার দীর্ঘ এক উপবৃত্তাকার টানেলে বসানো ছিল ওই যন্ত্রটি। পৃথিবীর একশতটি রাষ্ট্রের ১০,০০০ বিজ্ঞানী অক্লান্ত পরিশ্রম করিয়া হিগস বোসনের সন্ধান পান। এত বৃহৎ রাজসূয় যজ্ঞ বিজ্ঞান গবেষণায় বড় একটা দেখা যায় না। কোলাইডার যন্ত্রটিকে ম্যাটার মাইক্রোস্কোপও বলা হইয়া থাকে। অণুবীক্ষণ যন্ত্রে যেমন পদার্থের সূক্ষ্ম উপাদান দৃষ্টিগোচর হয়, তেমনই কোলাইডার যন্ত্রে কণায় কণায় মুখোমুখি সংঘর্ষে জাত চূর্ণবিচূর্ণ উপাদানগুলি পরখ করা হয়। উপাদান যত সূক্ষ্ম হইবে, তাহা পাইতে গেলে উক্ত ঘর্ষণের পরিমাণও তত তীব্র করিতে হইবে। এই কারণে পদার্থের সূক্ষ্ম হইতে সূক্ষ্মতর উপাদান খুঁজিতে কোলাইডার যন্ত্রটিকে বৃহৎ এবং বৃহত্তর বানাইতে হয়।

হিগস বোসন কণাটি তো খুঁজিয়া পাওয়া গিয়াছে। অতঃপর জানিতে হইবে উক্ত কণার ধর্ম কেমন। অর্থাৎ, কী কী রূপে তাহা অন্য কণার সহিত বিক্রিয়া করে, এবং বিক্রিয়া করিয়া কী উৎপাদন করে। তাহা জানার জন্য প্রয়োজন লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার অপেক্ষা বৃহৎ কোনও যন্ত্র। সম্প্রতি সার্ন কাউন্সিলের অধিবেশনে বিজ্ঞানীগণ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইলেন যে একশত কিলোমিটার পরিধিবিশিষ্ট বৃত্তাকার টানেলে আরও একটি সুপারকোলাইডার নির্মাণ আবশ্যক, যাহাতে দীর্ঘ পথে বিপরীত মুখে তীব্র বেগে ধাবমান ইলেকট্রন এবং পজ়িট্রন কণার সংঘর্ষ ঘটানো যায়। ওই রূপ সংঘর্ষে জাত কণার বিশ্লেষণে হিগস বোসনের ধর্ম উদ্‌ঘাটিত হইবে। পরিকল্পনার অর্থ তাহা রূপায়ণ নহে। উক্ত সুপারকোলাইডার নির্মাণে ২৪০০ কোটি ডলার ব্যয় হইবে, তাহাও আজিকার মূল্যে। দুই দশক পরে মূল্যবৃদ্ধির কারণে ওই ব্যয়ভার কোথায় দাঁড়াইবে, কে জানে। ওই ব্যয়ভার কাহারা জোগাইবে, তাহাই বা কে জানে। তথাপি বিজ্ঞানীরা পরিকল্পনা পাশ করিলেন। বিজ্ঞানের মূল সুরটি বিধৃত রহিল। কী সেই সুর? জ্ঞানান্বেষণ। জানার কোনও শেষ নাই বলিয়া জানার প্রয়াসে যতি টানিলে চলিবে না। ইহাই জ্ঞানের ধর্ম। বিজ্ঞানের ধর্ম।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement