মনে আছে টি এন শেষনকে? দোর্দণ্ডপ্রতাপ সেই মুখ্য নির্বাচন কমিশনার, যিনি একদা দেশে নির্বাচনী সংস্কার সাধনে ঝড় তুলেছিলেন। দিল্লির পান্ডারা পার্কে তাঁর বাসভবনে ঢুকতে গেলে জুতো খুলে ঢুকতে হত। অসংখ্য দেবদেবীর ছবির সামনে বসে আদুড় গায়ে দক্ষিণী স্টাইলে সাদা লুঙ্গি পরে একদা তিনি আমাকে বলেছিলেন, টাকার লোভ মানুষ্য প্রজাতির এক মস্ত দুর্বলতা। ভোটে কালো টাকার প্রভাব প্রতিপত্তি বন্ধ করা? মুখে বলা সোজা, বাস্তবায়িত করা? লর্ড বিষ্ণুরও অসাধ্য।
শেষন এক মজার গল্প শোনান। নির্বাচন সদনে তাঁর দফতরের দারোয়ানের কাহিনি। সকালে বহু মান্যগণ্য মানুষ মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। ওই দারোয়ান দরজায় দুটো টোকা দিয়ে অনেককে শেষনের ঘরে সোজা ঢুকিয়ে দিতেন। তিনি বলেন, পরে জেনেছিলাম, আমার দরজায় টোকা মারার জন্য লোকটা একশো-দুশো-পাঁচশো টাকা নিয়ে নেয়। এ দিকে আমরা দুর্নীতিমুক্ত ভারত গড়তে চাই। আর ভোটের সময়, কালো তা সে যতই কালো টাকা হোক, সে-ই তো নির্বাচনী গণতন্ত্রে জয়লাভের সর্বরোগহরা বটিকা।
এই দুর্নীতিমুক্ত ভারত গড়বে কে? দেশের পুরো রাজনৈতিক ব্যবস্থার পিরামিড— উচ্চ আসন থেকে নিচুতলা— সর্বস্তরে মানুষ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। সাধারণ মানুষকে রাষ্ট্র নিরন্তর সৎ দায়িত্বশীল নাগরিক হওয়ার পরামর্শ দিয়েই চলেছে। আর দেশের রাজনৈতিক নেতারা? ভোটের আগেই তাঁদের তহবিলে জমা হয় কোটি কোটি টাকা। কথায় বলে, রাজনৈতিক নেতাদের টাকা জোগায় ভূতে, খরচও করে ভূতে। সততার নামাবলি গায়ে শাসক ও বিরোধী সব নেতাই ব্যস্ত টাকার মায়ার খেলায়।
আবার ভোট এসেছে। তাই আবার নির্বাচনী ব্যয়বহুলতা নিয়ে আলোচনাও চলছে। কোনও এক চ্যানেলে দেখছিলাম, হিমাচল প্রদেশে কংগ্রেসের ওয়র রুম কার্যত জনমানবশূন্য। আর বিজেপির ওয়াররুম? যেন যুদ্ধকালীন তৎপরতা। রাশি রাশি কম্পিউটার। ঘর ভর্তি অল্পবয়সি ছেলেমেয়েরা কর্মরত। দুই শিবিরের দৃশ্যপটে এত ফারাক কেন? ২৪ আকবর রোডের এক প্রবীণ কংগ্রেস নেতা বললেন, বিজেপির ভোটব্যাংক আছে, সমর্থকের ভিড় আছে, কিন্তু তার চেয়ে বেশি আছে অর্থবল। আর অর্থবল রাজনীতিতে বাহুবল ও বাক্যবলেরও উৎস। টাকার প্রতিযোগিতায় বিজেপি অনেক এগিয়ে। নরেন্দ্র মোদী নিজেকে ধনী-বিরোধী নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে চান, কিন্তু বিজেপি অর্থবলে নাম্বার-ওয়ান।
কী ভাবে বিজেপি এ কাজে সফল হল? আজও এ এক অকথিত কাহিনি। উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা ভোটের আগে নোট বাতিলের সিদ্ধান্তে দেশের আর্থিক বিকাশের চিত্রটি উৎসাহব্যঞ্জক হয়ে ওঠেনি বটে, কিন্তু এই মোক্ষম চালে মুলায়ম ও মায়াবতীর দলকে বিজেপি ভোটের আগে নিঃস্ব করে দেয়। আকস্মিক সিদ্ধান্ত। সাবেকি অর্থসম্ভার তো সবটাই ছিল নগদ টাকায়। বিজেপির সে সময়কার আচরণ দেখে মনে হচ্ছিল, যেন ওঁরা আগাম জানতেন এমনটা হতে চলেছে। বিজেপি নেতা অমিত শাহ অস্বীকার করলেও যে ভাবে সে সময় বিজেপি নতুন দু’হাজার টাকার নোট বিলি করেছে তা দেখে চক্ষু চড়কগাছ হয়েছে অনেকের। বেশ কয়েকটি ব্যাংক থেকে নতুন নোট বের করার খবরও বিক্ষিপ্ত ভাবে এসেছিল। পুরনো টাকা বদলির সুযোগ শাসক দলে থাকলে পাওয়া যায়, সে কথা অনেকেই বলে!
ভোটের সময় টাকাই শেষ কথা, এমনটা বলছি না। মনমোহন সিংহ ভাল মানুষ, সে কথা আজও সবাই বলেন। কিন্তু দশ বছরের রাজত্বের পর নীতিপঙ্গুতা ও দুর্নীতির অভিযোগে গোটা দেশ জুড়ে পরিবর্তনের যে আবহ তৈরি হয়েছিল তা নিয়েও তো সন্দেহের অবকাশ নেই। সিপিএমের দীর্ঘ ৩৪ বছরের শাসনের পর মমতা যখন ক্ষমতায় এলেন, তখন গোটা রাজ্যে পরিবর্তনের যে ক্ষুধা দেখা গিয়েছিল সে তো শুধুই টাকার খেলা ছিল না। দেশের তখনকার ‘মুড’ মোদীকে ‘অচ্ছে দিন’-এর স্বপ্ন দেখানোর সওদাগর হতে সাহায্য করেছিল।
স্বাধীনতার পর কংগ্রেস দলের তহবিলে ছিল সবচেয়ে বেশি টাকা। দেশের জাতীয় বুর্জোয়াদের বিকাশ আর কংগ্রেসের বৃদ্ধির ঐতিহাসিক সম্পর্ক সুবিদিত। তার পর দীর্ঘ দিন ক্ষমতায় থাকার ফলে কংগ্রেস হয়ে ওঠে খানদানি দল। ভোটের সময় নেতা ও তাঁদের শাগরেদরা টাকা বিলির জন্য ট্রেনের বাতানুকূল শ্রেণিতে স্যুটকেস–ট্রাঙ্কে টাকা ভর্তি করে রাজ্যে রাজ্যে নিয়ে যেতেন। কংগ্রেসের প্রবীণ কোষাধ্যক্ষ প্রয়াত সীতারাম কেশরীর বলা গল্প অনেকেই জানেন। কী ভাবে সে সব টাকার বান্ডিল থেকে বিভিন্ন স্তরে মাঝারি ও ছোট নেতারা টাকা চুরি করতেন। দিল্লিতে প্রত্যেক নোটের বান্ডিল থেকে একটি করে টাকা খুলে নেওয়া হত এআইসিসি থেকে পিসিসি, প্রদেশ থেকে জেলা, জেলা থেকে ব্লক— ধারাবাহিক ভাবে। বান্ডিলের ওজন কমতে থাকত। আজ শিল্পপতিরা ভয়ে-ভক্তিতে যে ভাবে বিজেপিকে টাকা দিচ্ছে, কংগ্রেসকে তা দিচ্ছে না। সে দিন তাজ মানসিংহ হোটেলের চেম্বার্স-এ বসে এক ব্যবসায়ী বলছিলেন, আমরা সবাই ভয় পাচ্ছি, কখন কার বিরুদ্ধে এনফোর্সমেন্ট মামলা করে দেয়। তার চেয়ে না চাইলেও ওদের টাকা দেওয়া ভাল।
প্রয়াত এক সাংবাদিক এক বার আমাকে বলেছিলেন, ‘আগে আমাদের বিশ্লেষণ ছিল রাজনীতির সম্ভাব্য হিসেবনিকেশের ভিত্তিতে।’ তখন একটা ন্যূনতম মূল্যবোধের রাজনীতি ছিল। আর এখন? রাজ্যসভার সদস্যের মনোনয়ন থেকে কোনও নেতার নিজের দল ছেড়ে অন্য দলে যোগ দেওয়ার পিছনে থাকে আর্থিক কারণ। আমরা রাজনীতি বিশ্লেষণের সময় ওই অর্থবলের দাপটকে বিবেচনার শর্ত হিসেবে মনে রাখি না। তাই বিশ্লেষণে ভুল হয়ে যায়।
এ হল উত্তর-সত্য যুগ। আমরা কাজে কতটা সফলতা অর্জন করলাম, তার চেয়েও বড় কথা হল নাটকীয় উপস্থাপনা, আর যেন তেন প্রকারেণ ভোট জেতা। জয়ের কৌশল হল চাণক্য নীতি। এই যুক্তিতেই বলতে হবে, যুদ্ধে এবং প্রেমে কোনও অন্যায় নেই। বিজেপি ভোট করে চেকে, কালো টাকা কাকে বলে বিজেপি তা জানে না— এ কথাও এখন বিশ্বাস করতে হবে?
গুজরাতে চার দশক ক্ষমতায় থাকার পর সেখানে বিজেপি বিরোধী অসন্তোষের জন্ম তো অসত্য নয়। পটেল, তফসিলি ও মুসলমান সমাজের ত্রয়ী যে শাসক-বিরোধী হয়ে উঠেছে সে তো বিজেপি নেতারাই স্বীকার করছেন একান্ত আলোচনায়। তবু, এত কিছুর পর বিজেপির অর্থবল ও বাহুবল জনমতকে কতটা পরিচালিত করতে পারবে, অসন্তোষের আবহকে পাল্টে সাময়িক মোহবিষ্ট করতে সফল হবে ভোটারদের— এটাই অমিত শাহের সামনে চ্যালেঞ্জ। আপাতত সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের প্রতিধ্বনি করি: টাকার টঙ্কারে শুনি মায়া এ পৃথিবী।