সংবাদমাধ্যমের আচরণে কেন্দ্রীয় সরকার মর্মাহত হইয়াছে। নরেন্দ্র মোদীর ভাবমূর্তিটি বজ্রের মতো কঠিন হইলেও মর্মটি বুঝি বা কুসুমের ন্যায় কোমল, অতি অল্পেই আহত হয়। মুডি’জ অ্যানালিটিক্স-এর এক ‘নবীন’ কর্মীর মূল্যায়নকে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম কেন এত বেশি গুরুত্ব দিয়াছে, ইহাই সেই আহত মর্মের প্রশ্ন। মূল্যায়নটি মোদী সরকারের অনুকূল হইলে নিশ্চয়ই বিশ্লেষণকারী কর্মীর নবীনতা লইয়া প্রশ্ন উঠিত না, হয়তো বা প্রধানমন্ত্রী বিহারের জনসভায় সেই প্রশংসাবাক্য উদ্ধৃত করিয়া সমবেত ভক্তবৃন্দকে ‘নবীনের বাণী’ শুনিতে বলিতেন। কিন্তু মূল্যায়ন প্রতিকূল, ওই বিশ্লেষণে বলা হইয়াছে যে, প্রধানমন্ত্রী তাঁহার দলের নানাবিধ সদস্য ও অনুগামীর অসহিষ্ণু প্রগল্ভতা নিয়ন্ত্রণে তৎপর না হইলে তাঁহার বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ণ হইবে, ভারতীয় অর্থনীতির পক্ষে তাহা ক্ষতিকর। সরকারি কর্তারা চাহিলে এই মতকে উপেক্ষা করিতে পারিতেন। মোদী সরকার সেই কৌশল জানেন। কিন্তু সম্ভবত চতুর্দিক হইতে আক্রান্ত হইয়া তাঁহাদের পাটোয়ারি বুদ্ধিও গিয়াছে, সম্পূর্ণ অকারণ ক্ষোভে তাঁহারা বেসামাল হইতেছেন।
আহত ক্ষোভ সামলাইয়া শান্ত ভাবে ভাবিয়া দেখিলে শাসকরা বুঝিবেন, মুডি’জ অ্যানালিটিক্স-এর নবীন কর্মী তাঁহাদের যথার্থ হিতৈষী। তাঁহার সদুপদেশ শুনিলে এবং সেই অনুসারে আত্মসংশোধনে ব্রতী হইলে সনিয়া গাঁধী বা নীতীশ কুমারের উপকার হইবে না, সপারিষদ নরেন্দ্র মোদীই উপকৃত হইবেন। সুশাসন এবং উন্নয়নের মাপকাঠিতে তাঁহার বিশ্বাসযোগ্যতা যে দ্রুত কমিতেছে, তাহা এখন স্পষ্ট। রঘুরাম রাজন হইতে এন আর নারায়ণমূর্তি, কিরণ মজুমদার শ হইতে স্বয়ং রাষ্ট্রপতি— একের পর এক যে বার্তাগুলি ভাসিয়া আসিতেছে, তাহার মর্ম বুঝিতে অস্বাভাবিক বুদ্ধির প্রয়োজন হয় না, কাণ্ডজ্ঞানই যথেষ্ট। সংবাদমাধ্যমে সমালোচনা সম্পর্কে বর্তমান শাসকরা— শাসকের চিরাচরিত ধর্ম মানিয়াই— অতিমাত্রায় স্পর্শকাতর, কিন্তু তাঁহারা মনে মনে বিলক্ষণ জানেন যে, সংবাদমাধ্যম সমাজের মতামতের প্রতিধ্বনি করে। নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হইবার পরে দেশে ও বিদেশে সংবাদমাধ্যম তাঁহার প্রতি রীতিমত আনুকূল্য প্রদর্শন করিয়াছিল। তাঁহার ভাবিয়া দেখা উচিত, এত দ্রুত কেন তাঁহার সরকারের মর্মে আঘাত লাগিতেছে।
সচরাচর একটি সরকার তাহার মধ্যপর্বে বড় আকারের বিরাগ বা বিরূপতার সম্মুখীন হইতে শুরু করে। রাজীব গাঁধী বা নরসিংহ রাওয়ের অভিজ্ঞতা স্মরণীয়। মনমোহন সিংহের দ্বিতীয় দফার অভিজ্ঞতাও ইহারই অনুরূপ। সেই মাপকাঠিতে বিচার করিলে নরেন্দ্র মোদীর স্বর্গ হইতে বিদায়ের পালা অস্বাভাবিক দ্রুত শুরু হইয়াছে। অথচ ভাগ্যদেবী তাঁহার প্রতি বিশেষ ভাবে সদয় ছিলেন। তাঁহার প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রথম বছরে বিশ্ব বাজারে পেট্রোলিয়মের দাম অপ্রত্যাশিত ভাবে কমিয়া যায়, ফলে সরকারি ব্যয়ের বোঝা লাঘব হয়, মূল্যবৃদ্ধির চাপও কমে। কিন্তু তিনি এমন অনুকূল পরিস্থিতিকে কাজে লাগাইয়া অর্থনীতির সংস্কার সাধন করিয়া আয়বৃদ্ধির গতি বাড়াইতে পারেন নাই, তাঁহার ‘অচ্ছে দিন’ বিস্তর গর্জাইয়াছে, এক পশলাও বর্ষায় নাই। তাহার উপর এখন যুক্ত হইয়াছে অসহিষ্ণুতার এই মহাপ্লাবন, যাহা কেবল অন্যায় এবং অনৈতিক নহে, সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয়। নরেন্দ্র মোদী যদি উন্নয়ন চাহেন, তবে তাঁহার অনুগামীদের খামখা শাহরুখ খানকে কুৎসিত আক্রমণ করিবার কী প্রয়োজন ছিল, তাহার কোনও সদুত্তর কি প্রধানমন্ত্রীর ঝুলিতে আছে? তাঁহার সরকার ক্রমশ পাঁকে ডুবিতেছে, ইহা নির্মম সত্য। দেওয়ালের লিখন এখনও পড়িতে না পারিলে সত্যই মর্মাহত হইবার আরও অনেক কারণ ঘটিবে।