কেন্দ্রে দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় আসার পর বিজেপির সরকার যে স্বপ্ন দিয়ে বাজেট রচনা করে বা যে প্রত্যয়ের সঙ্গে কাশ্মীর বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে বা পরবর্তী সময়ে তাদের যে একের পর এক ‘কঠিন সিদ্ধান্ত’ নিতে দেখা যায়, তাতে এক ‘শক্তিমান’ শাসকের রূপ প্রতিফলিত। গাণিতিক গরিষ্ঠতায় বলীয়ান সরকার যেন এক নতুন সময় নির্মাণে প্রতিশ্রুত।
এ হেন সময়ে আপাত সরল বিষয়কে হেলায় অবজ্ঞা করার প্রত্যয় জন্মে। কিংবা আপাত বিরুদ্ধ বিষয়কে স্বীকার করার উদার্য্য প্রকাশ পায়। কিন্তু বাস্তব সেকথা বলে না। বাস্তবে আমরা দেখি দোর্দণ্ডপ্রতাপ শাসকের মনের গভীরে উঁকি মারে ভয়। সে ভয় সত্যের মুখোমুখি হওয়ার। সে ভয় সত্যকে জ্ঞাত করার।
উত্তরপ্রদেশের দাদরিতে মহম্মদ আখলাককে আমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, ২০১৫ সালে ঘরে গোমাংস আছে সন্দেহে যাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। সেই প্রথম, তার পর পেহলু খান। পরবর্তী সময়ে তথাকথিত গোবলয়ে ‘মব লিঞ্চিং’ বা ‘গণপ্রহারে মৃত্যু’ শব্দবন্ধ বিশেষ প্রাসঙ্গিকতা পায়। হাত-ফেরতা তথ্য বলে, ২০১৭ সালের মাঝ পর্যন্ত প্রায় ২৮ জনকে এ ভাবে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু এ সম্পর্কে সাম্প্রতিক সময়ে সরকারি তথ্য অমিল। কারণ সম্প্রতি প্রকাশিত ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড বুরোর বার্ষিক রিপোর্ট ২০১৭-তে যে ২৫টি অপরাধ সম্পর্কে তথ্য প্রকাশিত হয়নি, তার মধ্যে রয়েছে গণপ্রহারে মৃত্যু।
‘গণপ্রহারে হত্যা’ বিভাগটি ২০১৫ সালে যোগ হয়েছিল মহম্মদ আখলাক এবং পেহলু খানের হত্যার পরে। ২০১৬ সালের রিপোর্টেও এ সম্পর্কে পরিসংখ্যান প্রকাশ পেয়েছিল। তবে সাম্প্রতিক রিপোর্টে শুধু গণপ্রহারে হত্যা নয়, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়ে গণধর্ষণ, গোরক্ষা সংক্রান্ত অপরাধ, তথ্যের অধিকার আন্দোলনকারীর প্রতি হিংসা, বিগত তিন বছরে কৃষক আত্মহত্যার পরিসংখ্যানও প্রকাশিত হয়নি, কারণ ওই সকল অপরাধের তথ্য নাকি ‘অস্পষ্ট’ এবং তেমন ‘আস্থাযোগ্য নয়’। তবে অস্বস্তিকর তথ্যকে জ্ঞাত না করে চেপে যাওয়ার চেষ্টা এই প্রথম নয়। ভারতের ক্রমবর্ধমান বেকারত্বের তিক্ত সত্য এড়াতে সরকার দীর্ঘদিন সে সংক্রান্ত পরিসংখ্যান প্রকাশ করতে দেয়নি। তাতে আন্তর্জাতিক মহলে সমালোচনা হয়েছে। পরে যখন এ বিষয়ে জাতীয় নমুনা সমীক্ষার পরিসংখ্যান প্রকাশ্যে এল তখন দেখা গেল, বেকারত্বের হার বিগত ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ স্তরে উন্নীত হয়েছে।
সম্প্রতি ভোগ ব্যয় নিয়ে জাতীয় নমুনা সমীক্ষা সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানও দিনের আলো দেখল না। তবে ঘুরপথে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেল, সাড়ে চার দশক পরে এই প্রথম ভারতীয়দের মাথা-পিছু মাসিক ব্যয় কমল। খাদ্য-বস্ত্র সহ অন্য প্রয়োজনীয় পণ্যের জন্য এক জন গড়পড়তা ভারতীয় ১৯১১-১২ সালে মাসে খরচ করতেন ১,৫০১ টাকা। ২০১৭-১৮ সালে সেই খরচ কমে দাঁড়িয়েছে ১,৪৪৬ টাকায়। এক দিকে তথ্য বলছে বেকারি বেড়েছে, অন্য দিকে ব্যয় ক্ষমতা কমছে। ফলে আশঙ্কা করা হচ্ছে, দরিদ্র পরিবারের সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু সরকার বাহাদুর যেহেতু চাইছেন না যে ভোগ ব্যয় সম্পর্কিত জাতীয় নমুনা সমীক্ষার তথ্য প্রকাশিত হোক, তাই দারিদ্রের গতি-প্রকৃতি জানার উপায় অধরা থেকে যাচ্ছে, অর্থনৈতিক বা সামাজিক গবেষণায় যা বড় প্রতিবন্ধক হিসেবে পরিগণিত হতে পারে। সমস্যা হতে পারে নীতি নির্ধারণেও।
নব-নির্বাচিত মোদী সরকার প্রথম বাজেটে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতির স্বপ্ন দেখিয়েছিল। পরে ব্রিকস সম্মেলনেও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে বলতে শোনা গিয়েছে, ২০২৪ সালের মধ্যে ভারত ৫ লক্ষ কোটি ডলার মাপের অর্থব্যবস্থা হবে। বর্তমানে বিশ্বে ষষ্ঠ, ভারতীয় অর্থব্যবস্থার আয়তন ২.৬১ লক্ষ কোটি ডলার। আগামী পাঁচ বছরে আমাদের অর্থনীতির আয়তন যদি প্রায় দ্বিগুণ করতে হয়, তবে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১২ শতাংশ হারে বৃদ্ধি কাম্য। অথচ ২০১৯-২০ অর্থবর্ষের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর এই তিন মাসে ভারতীয় অর্থব্যবস্থার বৃদ্ধির হার ৪.৫ শতাংশ এবং সেটাও নাকি গণনা পদ্ধতিতে কারচুপির কল্যাণে। বাস্তবে বৃদ্ধির হার নাকি আরও কম। সেই সত্যের মুখোমুখি হওয়ার ভয়।
বাজেট পেশের পরবর্তী সময়ে অর্থনীতিতে একের পর এক ধাক্কার খবর এসেছে। বিস্কুট থেকে গাড়ি, সকল প্রকার পণ্যের বিক্রি কমেছে। কৃষি থেকে শিল্প উৎপাদন, রিয়্যাল এস্টেট থেকে বিদ্যুৎ, সব ক্ষেত্রেই বৃদ্ধির হার নিম্নগামী হয়েছে। অথচ সরকারের তরফ থেকে আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে চিন্তার কোনও কারণ নেই । শেষ অবধি অর্থমন্ত্রক স্বীকার করেছে যে অর্থনীতি গাড্ডায় পড়েছে বটে, তবে এ মন্দা নয়। এ দিকে খোদ সরকারি পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, এক দিকে নভেম্বরের খুচরো বাজারে মূল্যবৃদ্ধি ৫.৫৪ শতাংশ, অন্য দিকে অক্টোবরের শিল্পোৎপাদন ৩.৪ শতাংশ কমেছে। আর জুলাই-সেপ্টেম্বরে বৃদ্ধির হার কমে ছয় বছরে সর্বনিম্ন হয়েছে। ফলে অর্থনীতিবিদদের ভ্রু কুঞ্চিত হচ্ছে। তাঁরা ভাবছেন, তবে কি অর্থনীতি ‘স্ট্যাগফ্লেশন’-এর দিকে এগোচ্ছে?
‘স্ট্যাগফ্লেশন’ কি? আমেরিকার নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ পল স্যামুয়েলসন একই সঙ্গে মুদ্রাস্ফীতির হার বাড়তে থাকা ও আর্থিক বৃদ্ধি কমে যাওয়ার ফলে বেকারত্ব বেড়ে যাওয়ার নাম দিয়েছিলেন ‘স্ট্যাগফ্লেশন’। ১৯৭০ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে আমেরিকায় এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। কারণ ছিল তেলের দাম বৃদ্ধি। এখন অর্থনীতির অগ্রগতি ও উন্নয়ন থমকে, শিল্পের কর্মকাণ্ড ঝিমিয়ে, বেকারত্ব বাড়ছে। অথচ জিনিসের দাম বাড়ছে। দাম বাড়লে অর্থনীতির তত্ত্ব অনুযায়ী বেকারত্ব কমে। কিন্তু এখন আর্থিক বৃদ্ধির হার কমে যাওয়ায় বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। আগামী দিনে আরও বাড়বে না, এটা জোর দিয়ে বলতে পারছি কোথায়? ফলে আশঙ্কা করা হচ্ছে যে আমরা ‘স্ট্যাগফ্লেশন’-এর জাঁতাকলে পড়তে চলেছি, সামনের বাজেটের আগে যা সরকারের শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে উঠতে পারে।
সরকার মন্দা মানতে চাইছে না। অথচ ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য বহু কোটি টাকা লোকসান করে কর্পোরেট করে ছাড় দেওয়া হল। সরকারের উচিত ছিল, কর্পোরেট করে ছাড় না দিয়ে এই টাকা সামাজিক ক্ষেত্রে খরচ করা। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, গরিবের হাতে টাকা দিতে হবে, ধনীর হাতে আর নয়। ভারতের ১৩৫ কোটি মানুষের ৭০ শতাংশের গ্রামে বাস। তাঁদের চাহিদার দিকে নজর দিলে সার্বিক চাহিদা ঘাটতি কিছুটা প্রশমিত হতে পারত। সে ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী কিসান সম্মান নিধি যোজনা, যা ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিকে বছরে ৬,০০০ টাকা দেওয়ার কথা বলে, তার বাস্তব রূপায়ণে আরও যত্নবান হওয়া যেত। অন্য দিকে ১০০ দিনের কাজে শ্রমিকদের বকেয়া মজুরির পরিমাণ ২৫ হাজার কোটি টাকা। সেই বকেয়া টাকা মেটাতেও উদ্যোগী হওয়া যেত। সে সব না করে কর্পোরেট কর হ্রাস করে ১.৪৫ লক্ষ কোটি টাকা লোকসান হল। নিট ফল তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি।
সব মিলিয়ে এই সরকার কেবল সত্যের মুখোমুখি হতে ভয় পাচ্ছে না, কিছু অর্থে দিশাহীনও বটে। এ বড় সুখের সময় নয়।
মাজদিয়া সুধীরঞ্জন লাহিড়ি মহাবিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক