সেজেছে মণ্ডপ। নিজস্ব চিত্র
এভি স্কুল মোড়ে সেন্ট্রাল ক্লাবের পুজো মণ্ডপে তখন চাল চিত্র আঁকার কর্মশালা চলছিল, এমন সময়ে দু’জন মহিলা একটা হলুদ কাগজে কালো কালিতে লেখা পোস্টার নিয়ে মণ্ডপে ঢুকসেন। তার পর অনুরোধ জানালেন, অনুগ্রহ করে পোস্টারটা যেন পুজো মণ্ডপের দেওয়ালে আটকানো হয়। পুজো আয়োজকেরা হাসিমুখে তা লাগাতে সম্মত হলে, তাঁরা চলে যান অন্য মণ্ডপে।
এঁরা নদীসমাজের প্রতিনিধি। শহরের প্রতিটা মণ্ডপে এ ভাবেই পরিবেশরক্ষার প্রচার চালাচ্ছেন ওঁরা। পোস্টারটায় লেখা ছিল জলঙ্গি নদী বাঁচানোর, প্লাস্টিকমুক্ত পুজো করার, গাছ লাগানোর আহ্বান সহ বেশ কয়েকটি আবেদন। কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পুজোয় এই বছর শহর জুড়ে পরিবেশ রক্ষা আর প্লাস্টিক বর্জনের বার্তা। পুজো মণ্ডপের থিমও যতটা সম্ভব পরিবেশবান্ধব করার চেষ্টা দেখা গেল অনেক ক্ষেত্রেই।
পুজোটা যে এ বার অন্য বারের চেয়ে অনেকটাই অন্য রকম হবে, তার ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল কালীপুজোর বিসর্জনের পরেই। সাধারণত প্রতি বছর বিসর্জনের পরের দিন বিসর্জনের শোভাযাত্রা যাওয়ার রাস্তার দু’পাশে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকে থার্মোকল বা প্লাস্টিকের কাপ, প্লেট, ক্যারি প্যাকেট। এ বছর তা দেখা গেল না মোটেই। সে জায়গায় চোখে পড়ল কিছু কাগজের কাপ, শালপাতা বা কাগজের প্লেট আর ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা পুরনো খবরের কাগজ। বিসর্জনের ঘাটেও জলে পরে থাকা প্লাস্টিকের প্যাকেট বা ফুল মালার পরিমাণ ছিল খুবই কম। এর কৃতিত্ব অবশ্যই অক্টোবরের ১৭ তারিখ থেকে প্লাস্টিকের ক্যারিপ্যাকেট আর থার্মোকলের কাপ প্লেট, থালা, বাটির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে লাগু হওয়া পুরসভার নতুন আইন, বিভিন্ন পরিবেশপ্রেমী সংস্থার লাগাতার প্রচার আর শহরের মানুষের সহযোগিতা। তারই ফল এ বারের জগদ্ধাত্রী পুজো।
গোলাপট্টি বারোয়ারির এবারের থিম অপরূপ বাংলা। সেখানে মণ্ডপ তৈরি হয়েছে পাট, কাগজ, পোড়ামাটির মতো নানা পরিবেশবান্ধব উপকরণ দিয়ে। পুজোর সম্পাদক অয়ন দত্ত বলেন, ‘‘প্রথমে কথা হয়েছিল থার্মোকলের ছোট ছোট বাটি ব্যবহার করা হবে পুজো মণ্ডপ সাজাতে। কিন্তু গত মাসের নতুন আইনের পর সিদ্ধান্ত নিই আমরা মানুষকে সচেতন করতে মণ্ডপসজ্জায় কাগজের কাপ, প্লেট, শালপাতার বাটি ব্যবহার করব। তাই করেছি।’’ যদিও তিনি স্বীকার করে নিলেন পুরোটা পরিবেশবান্ধব করা এই অল্প সময়ে সম্ভব হয়নি। মণ্ডপে প্লাস্টিকের মালা ব্যাবহার করা হয়েছে এক জায়গায়। তবে আগামীতে সবটাই পরিবেশবান্ধব করে তোলার ইচ্ছে আছে এ কথা জানালেন পাড়ার সবাই। চৌধুরী পাড়ার মণ্ডপ যেমন তৈরি হয়েছে বাঁশের চাটাই দিয়ে। রায় পাড়া মালিপাড়ার পুজোয় দেখা গেল প্লাস্টিক বর্জনের বার্তা দিতে প্লাস্টিক অসুরের মডেল তৈরি করা হয়েছে। ষষ্ঠীতলা বারোয়ারির এই বছরের পুজোর থিম— পরিবেশ বাঁচাও আর জল সংরক্ষণ। প্লাস্টিকের বোতলের মুখ কেটে তার মধ্যে গাছের চারা লাগিয়ে পরিবেশ বাঁচানোর আর প্লাস্টিকের পুনর্ব্যবহারের মাধ্যমে দূষণ নিয়ন্ত্রণের বার্তা দেওয়া হয়েছে সেখানে। একই চিত্র দেখা গেল বাগদিপাড়ার পুজো মণ্ডপেও। সেখানে পিজবোর্ড কেটে ছোট ছোট অনেক পাখির বাসা তৈরি করা হয়েছে পাখি বাঁচানোর বার্তা দিয়ে। সেই সঙ্গে প্লাস্টিকের বোতলে লাগানো চারাগাছ দিয়ে সাজানো হয়েছে গোটা মণ্ডপ। বেশির ভাগ বারোয়ারি থেকেই পোস্টার, ব্যানার, মাইকিং বা মুখে মুখে বার্তা দেওয়া হচ্ছে প্লাস্টিক ক্যারি প্যাকেট বা ওই জাতীয় কিছু নিয়ে যেন পুজোয় নিয়ে না আসা হয়।
ঘূর্ণি নবারুণ সঙ্ঘের এক প্রতিনিধি মানু অধিকারী যেমন বললেন, ‘‘আমরা বেশ কয়েক বছর ধরে চেষ্টা করছি মণ্ডপের ভিতরে বা সামনে বসা দোকানিরা যেন প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগ বা কাপ-গ্লাস ব্যবহার না করেন। কিন্তু আটকাতে পারিনি। এ বছর আমাদের সঙ্গে আইন আছে। খুশি আমরা।’’
যদিও পুজো মণ্ডপ তৈরিতে থার্মোকলের ব্যবহার, রাস্তায় রাস্তায় পরিবেশবান্ধব নয় এমন প্লাস্টিক জাতীয় কাপড়ের তৈরি ফ্লেক্সের ছড়াছড়ি। কয়েকটি মণ্ডপসজ্জায় প্রচুর প্লাস্টিকের ফুলও ব্যবহার হয়েছে চোখে পড়ল। ছুতোর পাড়ায় রাস্তার উপর তৈরি হয়েছে ফ্লেক্সের বড় বড় গেট। যার মধ্যে আবার একটা গেটে প্লাস্টিক বর্জনের বার্তা দেওয়া আছে। এ তো সেই ‘সর্ষের মধ্যেই ভূত’-এর মতোই ব্যাপার। অবশ্য পুজো উদ্যোক্তারা প্রায় সবাই স্বীকার করে নিচ্ছেন, ফ্লেক্স ব্যবহার ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু এত বড় বড় কাপড়ের ফ্লেক্স এখন পাওয়া সম্ভব নয়। বিভিন্ন বিজ্ঞাপন সংস্থা যে সব বিজ্ঞাপনের ব্যানার দিয়ে যাচ্ছে মণ্ডপে টাঙানোর জন্য, তা-ও সেই প্লাস্টিক কাপড়ের ফ্লেক্স। ফলে, তাই টাঙাতে বাধ্য হচ্ছেন উদ্যোক্তারা।
তবে চেষ্টা যে হচ্ছে, তা বোঝা গেল মল্লিকপাড়া জলকল বারোয়ারিতে গিয়ে। সেখানে মণ্ডপ তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে বাঁশ, পাট, চটের মতো নানা পরিবেশবান্ধব উপকরণ। পুজোর সক্রিয় সদস্য দেবজ্যোতি দাস বলেন, ‘‘আমাদের থিম বিদ্যাসাগরের জন্মের দ্বিশতবর্ষ। বিদ্যাসাগরের জীবনীর বিভিন্ন ঘটনাগুলি লেখা আছে মণ্ডপের মধ্যে। কিন্তু কাপড়ের বড় ফ্লেক্স কৃষ্ণনগরে পেলাম না। বাধ্য হয়েই ছোট ছোট কাপড়ের ফ্লেক্সেই লিখেছি, অন্য ফ্লেক্স ব্যবহার করিনি।’’
দেবজ্যোতিও স্বীকার করে নিলেন পুরোটা পরিবেশবান্ধব করা সম্ভব হয়নি। মণ্ডপের মধ্যে অল্প কিছু কাজে থার্মোকল ব্যাবহার করতে হয়েছে। মণ্ডপের বাইরে কিছু বিজ্ঞাপনী ফ্লেক্স ও সেই প্লাস্টিক কাপড়েই দিয়ে গিয়েছে বিজ্ঞাপন সংস্থারা। থার্মোকল ছাড়া মণ্ডপ বানালে সে মণ্ডপ এমন সুন্দর হবে না বা এত সস্তা হবে না— বলছেন অনেক শিল্পীই। পাত্রবাজার স্বীকৃতি ক্লাবের সুবিশাল সুদৃশ্য মণ্ডপ গোটাটাই থার্মোকলের। ছুতোর পাড়ার প্রীতি সম্মিলনী ক্লাবের এ বারের থিম রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন। সেখানে টেরাকোটার নানা মডেল বানানো হয়েছে থার্মোকল কেটে টেরাকোটার রং করেই। শিল্পী সঞ্জু কুণ্ডু বলেন, ‘‘এত মডেল মাটির তৈরি করতে গেলে অনেক সময় আর অর্থ লাগত। তবে যে ভাবে সচেতনা বাড়ছে, আগামীতে তাই করতে হবে।’’ মণ্ডপ ও পুজোয় পরিবেশরক্ষার বার্তা আর চেষ্টা থাকলেও এই পুজোয় নানা জায়গা থেকে ব্যবসায়ীদের নিয়ে আসা বিভিন্ন পসরা, তা সে তিলেখাজা থেকে আলুভাজা, খেলনা থেকে পুজো মণ্ডপের বাইরে বিক্রি হওয়া ল্যামিনেটেড ঠাকুরের মুখ সবই তো বিকোচ্ছে প্লাস্টিকের প্যাকেটে মুড়ে! এ ছাড়া কেক, বিস্কুট, চিপস-এর পুজোর সময়ে দেদার বিক্রি। সে সবই তো বিক্রি হয় প্লাস্টিকের প্যাকেটে। এই সব প্লাস্টিকের উপর নিয়ন্ত্রণ না এলে পুজোর শেষে শহরের চিত্র ঠিক কী দাঁড়াবে, তাই নিয়েই এখন প্রশ্ন তুলছেন শহরের পরিবেশপ্রেমীরা।
তবে এত কিছুর মধ্যেও পরিবেশ বাঁচানোর সদিচ্ছাটা ধরা পড়ছে, তা সত্যিই আশা জোগায়।