অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং এস্থার দুফলো
পাড়াগেঁয়ে কালচারে রয়েছে রতনের বউ, পলার মা— এ জাতীয় সম্বোধন। সে সব নারীর ব্যক্তিনাম নিয়ে কারও মাথাব্যথা থাকে না। তাঁদের বিবাহ পরবর্তী জীবনে স্বনামটি চিরতরে ঘুচে যায়। পরিবর্তে তাঁদের পরিচয়টি প্রতিষ্ঠা পায় জীবনসঙ্গী বা সন্তানের নামে। কিন্তু তাই বলে নোবেলেও! এ কেমন হল! ‘সস্ত্রীক নোবেল পেলেন অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়’ কিংবা ‘ফরাসি স্ত্রীকে নিয়ে অর্থনীতিতে নোবেল জিতলেন কলকাতার বাঙালি অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক...’— ঠিক এ জাতীয় শব্দবন্ধেই খবরের শিরোনাম দেখে একটু থতমতই খেতে হল। মানেটা বুঝতে সময় লাগল। সস্ত্রীক নোবেল বিষয়টা ঠিক কী জিনিস— একটু বোঝাবেন বন্ধুরা? মানে সস্ত্রীক নেমন্তন্ন বাড়ি যাওয়ার নিমন্ত্রণের মতো কোনও কিছু কি? না কি তিনি স্ত্রী ছাড়া নোবেল নিতে উঠবেন না বলে ঠিক করেছেন?
আরে, কী সব ভাবছিলাম! স্ত্রী-ও তো যে সে নন। অভিজিৎবাবুর স্ত্রী এস্থার দুফলো স্বয়ং এক জন অর্থনীতিবিদ। এ বার পরিষ্কার হল বিষয়টা। ভদ্রমহিলা নিজের যোগ্যতাতেই নোবেল পাচ্ছেন অর্থনীতিতে। কিন্তু সেই পরিচয়টাই বেমালুম চাপা পড়ে যাচ্ছে। কিন্তু এটা ঠিক কেন? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই মনের ভেতর তোলপাড় হচ্ছে।
আমরা জানি নোবেল হচ্ছে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার। যা পেতে দস্তুরমতো যোগ্যতা লাগে। অনেক প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে তবে এই নোবেল প্রাপ্তি। এস্থার দুফলো সেই বিরল প্রতিভার এক জন যিনি মনুষ্যকুলে অবশ্যই নিজের মেধার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে এই সম্মান পেয়েছেন। তবুও তাঁকে অভিজিৎবাবুর স্ত্রী হিসেবে চিহ্নিত হতে হচ্ছে কেন? প্রচারটা তো দুফলোর সঙ্গেই তাঁর জীবনসঙ্গীও নোবেল পাচ্ছেন বলে হচ্ছে না।
এ বাবা, তাই আবার হয় না কি! স্ত্রীর পরিচয়ে স্বামীর পরিচয়—তা হলে যে ঘোর অনাসৃষ্টি কাণ্ড হবে!
ডিনামাইট আবিষ্কর্তা আলফ্রেড নোবেল তাঁর সর্বশেষ উইলটি করেছিলেন মৃত্যুর ঠিক এক বছর আগে, অর্থাৎ ১৮৯৫ সালে। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন তাঁর সম্পত্তির প্রায় ৯৪ শতাংশ তিনি দান করলেন পুরস্কার প্রদানের জন্যয় তাঁর ইচ্ছেতেই মানবকল্যাণকর এবং অনন্যসাধারণ গবেষণার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন ব্যক্তি তথা প্রতিষ্ঠানকে পুরস্কার প্রদান করা হয়। মোট পাঁচটি ক্ষেত্রকে তিনি বেছে নেন— পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসাবিজ্ঞান, সাহিত্য ও শান্তি। ১৯০১ সাল থেকেই তাঁর নামাঙ্কিত ‘নোবেল’ পুরস্কার দেওয়া শুরু হয়। তিনি অর্থনীতির কথা না বললেও ১৯৬৯ থেকে সেটি চালু হয়। আসলে সুইডিস কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক সেভেরিজেস রিক্সব্যাঙ্ক ১৯৬৮ সালে তাঁদের ৩০০ বছর পূর্তিতে নোবেল ফাউন্ডেশনকে প্রভূত অর্থ প্রদান করেছিলেন। এই অর্থ দিয়েই আলফ্রেড নোবেলের সম্মানার্থে ‘দ্য সেভেরিজেস রিক্সব্যাঙ্ক প্রাইজ ইন ইকনোমিক সায়েন্সেস ইন মেমোরি অব আলফ্রেড নোবেল’ চালু হয়। আলফ্রেডের মৃত্যুদিন ১০ ডিসেম্বর সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে আনুষ্ঠানিক ভাবে এই পুরস্কার জগতের সেরা কৃতিদের হাতে তুলে দেওয়া হয় প্রতি বছর।
অক্টোবর মাসের প্রথম থেকেই নোবেল পুরস্কার প্রাপকদের নাম ঘোষণা হতে থাকে। এ বছর ১৪ অক্টোবর ঘোষিত হল অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ীদের নাম। তখনই আমরা জানলাম ২০১৯-এ অর্থনীতিতে নোবেল প্রাপক তিন জন। এক জন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাইকেল ক্রেমার। অন্য দু’জনের মধ্যে এক জন ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, অন্য জন ফরাসি অর্থনীতিবিদ এস্থার দুফলো। তাঁরা দু’জনেই আমেরিকার ম্যাসাচুসেট্স ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির অধ্যাপক।
আমরা দেখলাম খবরটি প্রচারের সময় অভিজিৎবাবুর নামের আগে সস্ত্রীক শব্দটি জুড়ে গিয়েছে। বিষয়টি হল দুফলো অভিজিৎবাবুর স্ত্রী। আবার, তাঁরা একই সঙ্গে একই পুরস্কার পাচ্ছেন। এখানেই হল মূল সমস্যা। দুফলো যদি একই বছরে না পেয়ে অন্য বছরে নোবেল পেতেন বা অন্য প্রাপকদের মধ্যে কেউ তাঁর সঙ্গে বিবাহ-সম্পর্কে আবদ্ধ না হতেন, তা হলে কিন্তু তাঁকে নিজস্ব পরিচয়েই স্বতন্ত্র ভাবে চিহ্নিত করা হত। কিন্তু আমাদের শিরায় শিরায় এমন ভাবে পুরুষ প্রাধান্যের স্বীকৃতি বহমান যে, যেহেতু তিনি তাঁর জীবনসঙ্গীর সঙ্গে একই বছরে পুরস্কার পেলেন, কাজেই সেখানেও তিনি ‘অমুকের স্ত্রী’ গোছেরই হয়ে রইলেন।
অথচ, আমরা যদি খোঁজ নিই দেখব কী অনন্যসাধারণ প্রতিভাময়ী এই এস্থার দুফলো। ১৯৬৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মোট ৫০ বারে অর্থনীতিতে নোবেল পেয়েছেন ৮১ জন। প্রথমবার পেয়েছেন জ্যান টিনবারগেন ও রাগনার ফ্রিস। ইতিমধ্যে ৮১ জনের মধ্যে এক জনই নারী ছিলেন। যাঁর নাম এলিনর অস্ট্রম (মার্কিন)। ২০০৯ সালে অর্থনৈতিক প্রশাসন গবেষণার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য তিনিও অলিভার উইলিয়ামসের সঙ্গে যৌথ ভাবেই এই পুরস্কার পেয়েছিলেন। সে ক্ষেত্রে এস্থার দুফলো দ্বিতীয় নারী, যিনি অর্থনীতিতে নোবেল পেলেন। এটা তো একটা বিরাট কৃতিত্ব। নারীদের তো চতুর্দিক থেকে আটকানোর একটা স্বাভাবিক প্রবণতা পৃথিবী জুড়েই। সেখানে তাঁদের এ হেন আত্মপ্রতিষ্ঠা তো মহান গর্বের। এই গর্ব মানব সভ্যতার তথা সংস্কৃতির। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হল, অর্থনীতিতে দুফলোই সব চেয়ে কমবয়সী নোবেল প্রাপক।
দুফলো একাধারে ফরাসি ও মার্কিন নাগরিক। ১৯৭২ সালে প্যারিসে তাঁর জন্ম। এমআইটি-তে আব্দুল লতিফ জামিল পোভার্টি অ্যাকশান ল্যাব-এর তিনি সহ প্রতিষ্ঠাতা। ইতিহাস ও অর্থনীতি নিয়ে প্যারিসেই পড়াশোনা করেছেন। এমআইটি থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি করেন ১৯৯৯ সালে৷ অভিজিৎ বিনায়ক ছিলেন তাঁর জয়েন্ট সুপারভাইজার। মাত্র ২৯ বছর বয়সে দুফলো এমআইটির অধ্যাপক হিসাবে যোগ দেন। আমেরিকান ইকনোমিক রিভিউ-এর তিনি সম্পাদক। অভিজিৎ বিনায়কের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয় ২০১৫ সালে।
তাঁকে কুরনিস জানাই এই জন্যই যে তাঁর গবেষণা কর্মের নির্দেশক ও তিনি একই বছরে নোবেল পেলেন। মূলত দারিদ্র্য দূরীকরণে অভিজিৎবাবু ও দুফলো ব্র্যাকের উদ্ভাবিত আলট্রা পুওর গ্র্যাজুয়েশন মডেল অনুসরণ করেন। ২০০২ সালে ব্র্যাকের এই কর্মসূচি শুরু হয়েছিল। যার উদ্দেশ্য ছিল অতি দরিদ্র জনগণের অবস্থান্তর ঘটানো। তাঁদের দারিদ্র্য দূর করতে তাঁদের শুধু ঋণদানই নয়, প্রয়োজন মতো গবাদিপশু বা হাঁস-মুরগি প্রদান করা কিংবা নৌকা দিয়ে তাঁদের উপার্জনের ব্যবস্থা করা। আবার তাঁদের প্রশিক্ষিত করে সেগুলির সঠিক পরিচর্যা বা ব্যবহারে দক্ষ করে তোলার ব্যবস্থাও করা হয়।
অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ও এস্থার দুফলো বিশ্বের ছ’টি দেশে যেমন, ইথিওপিয়া, ঘানা, হন্ডুরাস, ভারত, পাকিস্তান ও পেরুর স্থানীয় এনজিও-র মাধ্যমে কাজে নামেন। ছয়টি দেশের দশ হাজার দারিদ্র্যক্লিষ্ট পরিবারের উপর সাত বছর ধরে গবেষণা করেন তাঁরা। যথেষ্ট সুফলও পান। তাঁরা লক্ষ করেন ওই মানুষগুলির খাদ্যগ্রহণের পরিমাণ, আর্থিক আয় সবই বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া গবাদিপশু-সহ অন্য সম্পদও তাঁরা বাড়াতে পেরেছেন।
এস্থার দুফলো ও অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গ্রন্থটি ২০১৯ সালে ‘হোয়াট দ্য ইকনমি নিডস নাও’ নামে প্রকাশিত হয়ে সর্বজন সম্মুখে আসে। ফলে এর প্রয়োগে অনেকেই এর সুফল ভোগ করবেন নিশ্চয়ই। কাজেই দুফলোর সামগ্রিক কর্মকাণ্ড চাপা পড়ে গিয়ে শুধুমাত্র অভিজিৎবাবুর সস্ত্রীক নোবেল পাওয়া বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া আর যাই হোক গর্বের নয়।
যোগ্যতার বিচারে মানুষ স্বনামে চিহ্নিত হোক। অন্য কারও পরিচয়ে তাঁকে ঢেকে ফেলাটা সভ্যতার পরিপন্থী।
শ্রীপৎ সিং কলেজের বাংলার শিক্ষক