অ-সহযোগ

সরকারি স্কুলগুলিতে ভর্তির সমস্যা হয়তো কম। কিন্তু তৎপরবর্তী পড়াশোনায় যে বিশেষ যত্নের প্রয়োজন, তাহা অনুপস্থিত। ‘স্পেশাল এডুকেটর’ বা বিশেষ প্রশিক্ষকের সংখ্যা নগণ্য। তাঁহারা কী ভাবে কাজ করিতেছেন, কতগুলি স্কুল পরিদর্শন করিতেছেন— নজরদারির অভাবও যথেষ্ট।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৪ মে ২০১৯ ০০:০২
Share:

প্রতীকী ছবি।

অসাধ্য সাধন করিয়াছে ময়ূখ মিত্র এবং সঙ্কল্প দাস। উভয়েই বোর্ডের পরীক্ষায় কৃতিত্বের সহিত উত্তীর্ণ। ময়ূখ আইসিএসই-তে ৯৩.৬ শতাংশ নম্বর পাইয়াছে, সিবিএসই-র দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষায় ৭৯ শতাংশ নম্বর পাইয়াছে সঙ্কল্প। অথচ, যাত্রাপথটি উভয়েরই মসৃণ ছিল না। ময়ূখের অটিজ়ম আছে, সঙ্কল্পের ডিসলেক্সিয়া এবং ওসিডি (অবসেসিভ কমপালসিভ ডিজ়অর্ডার)। এই প্রতিবন্ধ সত্ত্বেও তাহারা সফল। এই সাফল্য গর্বের, আনন্দেরও। কিন্তু এই দৃষ্টান্তগুলি ব্যতিক্রমী। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যার তুলনায় এই মাপের সাফল্যের পরিমাণটি ভয়াবহ কম। দীর্ঘ লড়াই চালাইবার জন্য যে সাহায্যের প্রয়োজন, প্রায়শই তাহারা পায় না। শিক্ষার অধিকার আইনের আদর্শকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখাইয়া বেসরকারি স্কুলগুলি অনেক সময়ই ভর্তি লইতে অসম্মত হয়। পরিকাঠামোর অজুহাত দেখায়। ভর্তির সিদ্ধান্ত সেখানে নির্ভরশীল বিদ্যালয়ের পরিচালকদের উপর। আবার কখনও পড়ুয়ার বৌদ্ধিক সমস্যার আঁচ পাইলেই সেই স্কুল ছাড়িয়া স্পেশাল স্কুলে ভর্তির জন্য চাপ আসে। সঙ্কল্প নিজেও স্কুলের এমন অসহযোগিতার শিকার।

Advertisement

সরকারি স্কুলগুলিতে ভর্তির সমস্যা হয়তো কম। কিন্তু তৎপরবর্তী পড়াশোনায় যে বিশেষ যত্নের প্রয়োজন, তাহা অনুপস্থিত। ‘স্পেশাল এডুকেটর’ বা বিশেষ প্রশিক্ষকের সংখ্যা নগণ্য। তাঁহারা কী ভাবে কাজ করিতেছেন, কতগুলি স্কুল পরিদর্শন করিতেছেন— নজরদারির অভাবও যথেষ্ট। নিয়মিত শিক্ষকরা এই ছাত্রছাত্রীদের পৃথক যত্ন লইতে অপারগ বা অনিচ্ছুক। উপরন্তু অটিজ়ম-এর মতো পরিস্থিতিতে সামাজিক মেলামেশায় অসুবিধার কারণে ছাত্র বা ছাত্রীটি বিদ্যালয়ে ক্রমশ একাকী হইয়া পড়ে। বিদ্যালয়ে আসিবার উৎসাহ হারায়। সরকারি ভাবে তাহাকে স্কুলছুট বলা না গেলেও অবস্থা কার্যত সেই রকমই দাঁড়ায়। পরিবারের সামর্থ্য থাকিলে সে তবু ব্যক্তিগত উদ্যোগে কিছু প্রশিক্ষণ পায়। অন্যথায়, ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। আইন বলে, শিক্ষা সকলের অধিকার। কিন্তু বাস্তব দেখাইতেছে শিক্ষার অধিকার শুধুমাত্র ‘সুস্থ’ এবং পারদর্শীদেরই। ইহার বাহিরে থাকা এক বড় সংখ্যক ‘বিশেষ’ মানুষদের অস্তিত্বকে সামাজিক ভাবে এবং সরকারি ভাবে কার্যত অস্বীকার করিয়া আসা হইতেছে।

ইহা তো গেল বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের কথা। সাধারণ শিশুদের অবস্থা কীরূপ? সেখানেও অ-সাধারণত্বেরই জয়জয়কার। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শ্রেণিকক্ষের পড়া যাহারা আত্মস্থ করিতে পারিবে, তাহারা অগ্রসর হইবে। যাহারা পারিবে না, পিছাইয়া পড়িবে। ইহাই নিয়ম। ফেল করা ছাত্রটিকে সামনের সারিতে আনিতে গেলে স্কুলের তরফে যে উদ্যোগ প্রয়োজন, তাহা নাই। শিক্ষকরা সচরাচর ধরিয়াই লন, শ্রেণিকক্ষের বাহিরে বাড়তি সাহায্যের ব্যবস্থা অভিভাবকরাই করিবেন। ফলে, পড়ুয়াদের মধ্যে যাহারা প্রাইভেট টিউশন পড়িতে পারে, ফাঁকটুকু ভরাট করিবার সুযোগ পায়। সামর্থ্যহীনরা হয় নিজ চেষ্টায় পড়া চালাইয়া যায়, নয়তো মাঝপথেই পড়া ছাড়িয়া দেয়। তাহাদের কথা না বিদ্যালয় ভাবে, না সরকার। প্রতিকার করিতে হইলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন শিক্ষাব্যবস্থার দায়িত্বপ্রাপ্তদের মানসিকতায় আমূল পরিবর্তন। একমাত্র তবেই শিক্ষায় সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব। তাহাতে বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের অধিকারের গুরুত্বও বাড়িতে পারে।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement